শুক্রবার। জুম্মার নামাজের পর বাড়িটা এক অদ্ভুত শান্ত ও পবিত্র আবহে ডুবে আছে। বসার ঘর থেকে লোবানের ধোঁয়া পাক খেয়ে উপরে উঠছে, সেই সুগন্ধে মিশে আছে এক গভীর প্রশান্তি। নাদিম সাহেব সবেমাত্র মসজিদ থেকে ফিরেছেন। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় জালি টুপি, মুখে প্রশান্তির ছাপ। তিনি সোফায় বসে তসবিহ পাঠ করছেন।
রান্নাঘর থেকে বিরিয়ানির ভাপ ওঠা প্লেট হাতে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন সুরাইয়া। মাথায় দোপাট্টাটা খুব যত্ন করে টানা, বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়লেও তার চালচলনে এক ধরণের স্নিগ্ধতা আছে। আমির তার ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসতেই বাবাকে দেখে বিনয়ের সাথে বলল, “আসসালামু আলাইকুম আব্বু।”
নাদিম সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। এসো বাবা, খেতে বসো। তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
আমির মাথা নিচু করে উত্তর দিল, “জি আব্বু, আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই চলছে।”
“মাশাআল্লাহ,” নাদিম সাহেব স্নেহমাখা স্বরে বললেন, “নামাজটা ঠিকমতো পড়ছ তো? দুনিয়ার পড়াশোনা জরুরি, কিন্তু আখেরাতের কথাও মনে রাখতে হবে। আল্লাহ চাইলে সব সহজ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।”
সুরাইয়া প্লেট সাজাতে সাজাতে বললেন, “ওকে আর বকবেন না। ও তো এমনিতেই সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে।” পরিবেশটা তখন স্নেহ, সম্মান আর এক অদৃশ্য ধর্মীয় শৃঙ্খলায় মোড়া ছিল, যেখানে প্রতিটি শব্দ আর নড়াচড়ায় ছিল পরিমিতবোধ।
সেদিন রাতেই সেই পবিত্রতার চাদরে যেন একটা সূক্ষ্ম ফাটল ধরল।
আমিরের সামনে বই খোলা, কিন্তু মনটা পড়ে আছে অন্য কোথাও। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, পড়ার চাপ প্রচণ্ড। গলাটা শুকিয়ে আসছিল, তাই জল খাওয়ার জন্য সে ঘর থেকে বের হলো। বসার ঘরের আলো নেভানো, শুধু বারান্দার রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের একটা আবছা হলুদ আলো জানলা দিয়ে ভেতরে এসে পড়েছে। সেই আলো-আঁধারিতে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকাতেই আমিরের পা দুটো যেন মেঝের সাথে আটকে গেল।
সে দেখল, তার আব্বু—সেই গম্ভীর, রাশভারী নাদিম সাহেব—রান্নাঘরের দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সুরাইয়া বোধহয় কাজ শেষ করে বের হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই নাদিম সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের খুব কাছে টেনে নিলেন।
দৃশ্যটা কোনোভাবেই অশ্লীল ছিল না, কিন্তু আমিরের কাছে তা ছিল ভূমিকম্পের মতো। আবছা আলোয় সে দেখল, সুরাইয়ার হাতটা নাদিমের বুকের উপর রাখা। আম্মির গলার স্বরটা শোনা গেল, যেন ফিসফিস করে ধমক দিচ্ছেন, “আরে, কী করছেন! ছাড়ুন… আমির জেগে আছে, ও শুনতে পাবে তো… গুনাহ্ হবে…”
নাদিম সাহেব সম্ভবত সুরাইয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা বললেন, হয়তো কোনো আদুরে খুনসুটি, যা আমির শুনতে পেল না। কিন্তু সে যা দেখল, তা তার চিরচেনা পৃথিবটাকে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার কাছে “আব্বু” আর “আম্মি” ছিল শ্রদ্ধার দুটি ভিন্ন সত্তা, যাদের সম্পর্কটা শুধু দায়িত্ব আর কর্তব্যের। কিন্তু আজ, এই আধো-অন্ধকারে, সে প্রথমবারের মতো তাদের দেখল “নারী” আর “পুরুষ” হিসেবে। তাদের মধ্যেও যে কামনা থাকতে পারে, স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে—এই বোধটা তাকে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলে দিল।
লজ্জা আর সংকোচে তার কান গরম হয়ে উঠল। মনে হলো, সে এমন কিছু দেখে ফেলেছে যা দেখার অধিকার তার নেই। জল খাওয়ার তৃষ্ণা কোথায় হারিয়ে গেল। সে নিঃশব্দে, চোরের মতো পা টিপে টিপে নিজের ঘরে ফিরে এলো এবং দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে দিল। বুকের ভেতরটা তখনো ধড়ফড় করছে।
দিনকয়েক কেটে গেছে। সেই অস্বস্তিটা মনের কোণে কাঁটার মতো বিঁধে ছিল, কিন্তু পড়াশোনার চাপে সেটা কিছুটা চাপা পড়েছিল। আমিরের ঘরটা তার বাবা-মায়ের শোবার ঘরের ঠিক পাশেই। পুরনো আমলের বাড়ি, তাই দুটো ঘরের মাঝে একটা সংযোগকারী কাঠের দরজা ছিল, যা বহু বছর ধরে ব্যবহার হয় না। দরজার উপরের দিকের একটা কাঁচের প্যানেল অনেকদিন আগেই ফেটে গিয়েছিল, সেখানে একটা ছোট ফাটল বা ফুটো রয়ে গেছে।
গভীর রাত। চারদিক নিঝুম। আমির পড়ার টেবিলে বসে নোটস তৈরি করছিল। হঠাৎ তার কানে এল একটা শব্দ। খাট নড়ার শব্দ—ক্যাঁচ… ক্যাঁচ…। তার সাথে মিশে আছে এক অদ্ভুত চাপা আওয়াজ, যেন কেউ গোঙাচ্ছে।
আমির কলমটা থামিয়ে কান খাড়া করল। প্রথমে তার বুকটা ধক করে উঠল, আম্মির কি শরীর খারাপ হলো? সে কি ব্যথায় কাতরাচ্ছে? কিন্তু ভালো করে কান পাততেই সে বুঝল, না, এটা যন্ত্রণার শব্দ নয়। এই গোঙানির মধ্যে এক ধরণের ছন্দ আছে, এক ধরণের আবেশ আছে যা সে আগে কখনো শোনেনি।
কৌতূহল আর এক অজানা আশঙ্কায় সে চেয়ার ছেড়ে উঠল। পা টিপে টিপে সেই বন্ধ দরজার কাছে এগিয়ে গেল। হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এসেছে। কাঁপতে কাঁপতে সে সেই ভাঙা কাঁচের ফুটোটার কাছে নিজের চোখটা রাখল।
ওপাশের ঘরে নাইট ল্যাম্পের নীলচে আলো জ্বলছে। সেই আবছা আলোয় সে যা দেখল, তাতে তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিল। সে দেখল, তার আব্বু—তার শ্রদ্ধেয় আব্বু—তার আম্মির শরীরের উপর ঝুঁকে আছেন। দুটো ছায়া শরীর একে অপরের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল নাদিমের চওড়া পিঠ আর তার নিচে সুরাইয়ার ছড়ানো চুলগুলো বালিশের উপর ঢেউ খেলছে। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসছে তাদের ভারী, ঘন ও ছন্দময় নিঃশ্বাসের শব্দ।
দৃশ্যটা অস্পষ্ট হলেও তার অর্থ আমিরের কাছে পরিষ্কার ছিল। ভয়ে, বিস্ময়ে এবং এক অজানা শিহরণে তার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। সে চোখ সরাতে চাইল, কিন্তু পারল না। এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ তাকে যেন চুম্বকের মতো আটকে রাখল সেই ফুটোটার সাথে…
আমির চোখ সরাতে চাইল, কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ওই ফুটোটার সাথে আটকে রাখল। তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। সে দেখল, আবছা আলোয় নাদিম সাহেবের হাতটা সুরাইয়ার পিঠ বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামছে। যে হাত দিয়ে তিনি তসবিহ গুনতেন, সেই হাতটাই এখন তার স্ত্রীর কোমরের মাংসল ভাঁজটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে।
সুরাইয়া যেন একটু নড়ে ওঠার চেষ্টা করলেন, হয়তো স্বামীর এই আকস্মিক আদরে তিনি লজ্জিত। কিন্তু নাদিম সাহেব তাকে ছাড়লেন না। তিনি সুরাইয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু একটা ফিসফিস করলেন। সেই ফিসফিসানি বাতাস ভারী করে তুলল। আমির কোনো শব্দ শুনতে পেল না, কিন্তু সে দেখল তার আম্মির শরীরটা শিথিল হয়ে আসছে, যেন তিনি স্বামীর এই পৌরুষদীপ্ত আহ্বানের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।
কাপড়ের আড়ালে খেলা (Fabric Play): সুরাইয়ার পরনে ছিল হালকা রঙের সালোয়ার কামিজ। নাদিম সাহেব এবার তার স্ত্রীর ওড়নাটা (দোপাট্টা) খুব আলতো করে টেনে সরিয়ে দিলেন। ওড়নাটা বিছানার একপাশে খসে পড়ল। এই দৃশ্যটা আমিরের কাছে ছিল বজ্রপাতের মতো। সে তার আম্মিকে সব সময় ওড়নায় ঢাকা দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এখন, নাইট ল্যাম্পের ওই মায়াবী আলোয়, তার মায়ের বুকের ওঠানামা স্পষ্ট।
নাদিম সাহেবের হাতটা এবার সুরাইয়ার কামিজের ওপর দিয়েই তার বুকের দিকে উঠে এল। আমির দেখল, তার বাবার বলিষ্ঠ আঙুলগুলো মায়ের নরম মাংসের ওপর চেপে বসছে। সুরাইয়া দুহাতে স্বামীর কাঁধ খামচে ধরলেন, তার মুখ থেকে একটা অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে এল—”উহ্… নাদিম…”। এই ডাকটা কোনো গৃহবধূর ডাক ছিল না, এটা ছিল এক কামাতুর নারীর আর্তি।
ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা (Sensory Expansion): ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুক-চুক করে চুমুর শব্দ ভেসে আসতে লাগল। আমির দেখল, তার বাবা ক্ষুধার্তের মতো তার মায়ের গলায়, ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছেন। নাদিম সাহেবের খোঁচা খোঁচা দাড়ি সুরাইয়ার ফর্সা ত্বকে ঘষা খাচ্ছিল, আর তাতে সুরাইয়া শিউরে উঠছিলেন। সেই শিহরণ যেন সংক্রমিত হলো আমিরের শরীরেও। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, কিন্তু নিজের অজান্তেই তার শরীর এক অদ্ভুত উত্তেজনায় সাড়া দিতে শুরু করল। এটা ছিল এক নিষিদ্ধ পাপ, এক চরম “গুনাহ্”, তবু সে নিজেকে ফেরাতে পারছিল না।
নাদিম সাহেব এবার সুরাইয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। সুরাইয়ার চুলগুলো বালিশের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। নাদিম সাহেব তার শরীরের ভার স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিলেন। তাদের শরীরের মাঝখানে কোনো ফাঁক রইল না। আমির দেখল, তার বাবার শরীরটা একটা ছন্দের তালে নড়ছে—ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত। যেন কোনো শিকারি তার শিকারকে বাগে পেয়েছে।
আমিরের মনে হলো, সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। এই দৃশ্য, এই শব্দ, এই নিষিদ্ধ উত্তেজনা—সব মিলিয়ে তার মাথা ঘুরছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার বাবা-মায়ের এই রূপ দেখার পর তার জীবন আর আগের মতো থাকবে না। তার শ্রদ্ধেয় আব্বু, স্নেহময়ী আম্মি—সবাই এক লহমায় বদলে গেছে। তারা এখন শুধুই একজন পুরুষ আর একজন নারী, যারা আদিম কামনার খেলায় মত্ত।
হঠাৎ, ওপাশের ঘর থেকে একটা জোরালো শ্বাস ফেলার শব্দ আর খাটের ক্যাঁচক্যাঁচানি বেড়ে গেল।
আমির শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু ওপাশের ঘর থেকে কোনো ধমক বা ভর্ৎসনার আওয়াজ এল না। তার বদলে ভেসে এল এক অদ্ভুত, ভেজা শব্দ—চুম্বনের শব্দ, যা আরও গভীর, আরও তীব্র হয়েছে। নাদিম সাহেব তার স্ত্রীর ঠোঁট থেকে মুখ সরিয়ে এবার নেমে এসেছেন গলার ভাজে। তার প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন আগুনের মতো সুরাইয়ার ত্বকে আছড়ে পড়ছে ।
খাটের ক্যাঁচক্যাঁচানিটা এখন একটা ছন্দে পরিণত হয়েছে। সুরাইয়ার হাতদুটো এখন আর নাদিমকে বাধা দিচ্ছে না, বরং তার পিঠের পাঞ্জাবিটা খামচে ধরে আছে। আমির দেখল, তার বাবার হাতটা সুরাইয়ার কামিজের নিচ দিয়ে পেটের ওপর উঠে এল। কাপড়টা কুঁচকে উঠে গেল বুকের কাছে। আবছা আলোয় সুরাইয়ার ফর্সা পেটের একাংশ দৃশ্যমান হলো। নাদিম সাহেব সেখানে মুখ গুঁজে দিলেন । সুরাইয়ার শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে উঠল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল এক অস্ফুট আর্তনাদ, যা তিনি বালিশে মুখ গুঁজে চাপা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন ।
আমির দেখল, তার মায়ের পা দুটো অস্থিরভাবে নড়ছে। যে পায়ে সব সময় ধীরস্থির চটি জুতো দেখা যেত, সেই পা দুটো এখন চাদরের ওপর ঘষা খাচ্ছে, আঙুলগুলো কুঁকড়ে আসছে চরম উত্তেজনায় । নাদিম সাহেব এবার একটু উঠে বসলেন। তার এক হাত সুরাইয়ার সালোয়ারের ফিতার কাছে চলে গেল। সুরাইয়া তার হাতটা ধরে ফেললেন, হয়তো শেষবারের মতো লজ্জা বা সংকোচ তাকে বাধা দিচ্ছিল।
“না… প্লিজ… শব্দ হবে…” সুরাইয়ার গলাটা কাঁপছে ।
কিন্তু নাদিম সাহেব থামলেন না। তিনি নিচু স্বরে, প্রায় ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন, যা আমিরের কানে এল না, কিন্তু তার প্রভাবে সুরাইয়ার হাতটা শিথিল হয়ে গেল। নাদিম সাহেব সালোয়ারের ফিতাটা আলগা করে দিলেন। সুরাইয়া চোখ বন্ধ করে ফেললেন, যেন তিনি এই আদিম স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।
আমিরের মনে হলো তার শরীরের রক্তপ্রবাহ উল্টো দিকে বইছে। তার নিজের শরীরের এক বিশেষ জায়গায় এক অদ্ভুত টান, এক অজানা উত্তেজনা অনুভব করল সে। এটা তার আম্মি, এটা তার আব্বু—এই চিন্তাটা বারবার তার মাথায় হাতুড়ি পেটালেও, চোখের সামনের দৃশ্যটা তাকে এক আদিম নেশায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। সে দেখল, নাদিম সাহেব সুরাইয়ার সালোয়ারটা ধীরে ধীরে পায়ের দিকে নামিয়ে দিচ্ছেন ।
ঠিক সেই মুহূর্তে, নাদিম সাহেব সুরাইয়ার উরুর মাঝখানে নিজের হাতটা রাখলেন। সুরাইয়া একটা বড় শ্বাস নিলেন, তার বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল । ঘরের বাতাসে এখন লোবানের পবিত্র গন্ধের বদলে মিশে আছে ঘাম আর কামনার এক তীব্র গন্ধ ।
আমির আর নিতে পারল না। এক ঝটকায় সে চোখ সরিয়ে নিল। তার কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে । সে টলতে টলতে নিজের বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়ল। তার হাত-পা কাঁপছে। পাশের ঘর থেকে তখনও আসছে সেই ছন্দময় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ আর অস্পষ্ট গোঙানি। সে দুই কানে হাত চাপা দিল, কিন্তু মনের ভেতর সেই দৃশ্যটা গেঁথে গেছে—তার বাবার বলিষ্ঠ পিঠ, মায়ের উন্মুক্ত পেট, আর ওই নিষিদ্ধ স্পর্শ।
সে রাতে আর আমিরের ঘুম এল না। সে শুধু ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল, আর তার শরীরের শিরা-উপশিরায় বয়ে চলল এক নতুন, অচেনা আগুনের স্রোত। তার পৃথিবীটা আজ রাতে চিরতরে বদলে গেছে। সে বুঝতে পারল, এতদিন সে যে জগতটাকে চিনত, তার আড়ালে লুকিয়ে আছে আরেকটা জগত—যেখানে নিয়ম নেই, আছে শুধু ক্ষুধা আর মিলন।
পরের দিন সকাল। ভোরের আলো ফুটেছে ঠিকই, কিন্তু আমিরের মনে হলো তার চারপাশটা এখনও কাল রাতের সেই নিষিদ্ধ অন্ধকারের চাদরে মোড়া। নাস্তার টেবিলে বসে আছে সে, কিন্তু গলার নিচ দিয়ে এক ফোঁটা জলও যেন নামতে চাইছে না। প্লেটের ওপরের গরম পরোটা থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু সেই পরিচিত গন্ধে আজ আর খিদে পায় না, বরং এক ধরণের বমি ভাব উঠে আসে।
সুরাইয়া রান্নাঘর থেকে এলেন, হাতে গরম পরোটা। তার মুখটা স্নিগ্ধ, সকালের আলোর মতো নির্মল। কাল রাতের সেই উথালপাথাল কামনার কোনো চিহ্নই এখন তার চোখেমুখে নেই। তিনি পরম মমতায় আমিরের প্লেটে একটা পরোটা তুলে দিলেন।
“নে, বাবা। কাল রাতে অনেক জেগেছিস। খা,” সুরাইয়ার গলার স্বরটা কী ভীষণ স্বাভাবিক, কী ভীষণ মাটির কাছাকাছি।
আমিরের হাতটা চায়ের কাপ ধরতে গিয়ে কেঁপে উঠল। সে তার আম্মির মুখের দিকে তাকাতে পারল না। তার দৃষ্টি আটকে রইল সুরাইয়ার হাতের দিকে—সেই হাত, যা দিয়ে তিনি এখন পরম স্নেহে ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন, আর কাল রাতে সেই হাতই আঁকড়ে ধরেছিল নাদিমের পিঠ। এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমিরের শরীর রি রি করে উঠল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী মনে হলো তার।
‘আমি কী করে…’ আমিরের মনের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল, ‘আমি কী করে আমার আম্মিকে ওই অবস্থায় দেখলাম? ছিঃ! আমি একটা জানোয়ার! আমি মায়ের সম্মান নষ্ট করেছি… আল্লাহ্ আমায় মাফ করবেন না… কোনোদিন মাফ করবেন না…’
সে মাথা নিচু করে পরোটা ছিঁড়তে চেষ্টা করল, কিন্তু আঙুলগুলো অবশ হয়ে আসছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যদি এখন মায়ের চোখের দিকে তাকায়, তবে মা হয়তো তার চোখের ভেতরে সেই নোংরা ছবিটা দেখতে পাবেন। মা বুঝে যাবেন, তার ছেলে কাল রাতে কী জঘন্য কাজ করেছে।
ঠিক তখনই নাদিম সাহেব খবরের কাগজটা নামিয়ে টেবিলে রাখলেন। কাগজের খসখস শব্দে আমির এমনভাবে চমকে উঠল যেন কেউ তার কানের কাছে পিস্তল চালিয়েছে।
“আমির?” নাদিম সাহেবের গলাটা ভারি।
আমির ভয়ে কুঁকড়ে গেল। তার হৃৎস্পন্দন এত দ্রুত হচ্ছে যে মনে হচ্ছে বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। আব্বু কি জেনে গেছেন? আব্বু কি কাল রাতে দরজার ওপাশের ওই চোখ দুটো দেখেছিলেন?
“জ্বি… জ্বি আব্বু?” আমিরের গলা দিয়ে স্বর বেরোল না প্রায়। সে ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাল। নাদিমের চোখে সেই চিরচেনা গাম্ভীর্য। কিন্তু আজ সেই গাম্ভীর্যের আড়ালে আমির অন্য কিছু খুঁজছে। সে খুঁজছে কাল রাতের সেই কামুক পুরুষটিকে, যে তার মায়ের শরীরকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এখন তার সামনে বসে আছেন কেবল তার ধর্মপ্রাণ পিতা। এই দ্বৈত সত্তা আমিরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছিল।
“পরীক্ষার আর কয়দিন বাকি? রিভিশন শেষ হয়েছে তো?” নাদিম স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন।
প্রশ্নের সরলতা আমিরকে আরও বেশি বিদ্ধ করল। বাবা তার পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত, আর সে কিনা বাবার গোপন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে বসে আছে! অপরাধবোধের ভারে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
“জ্বি… হচ্ছে… ইনশাআল্লাহ হয়ে যাবে,” আমির তোতলামি করে উত্তর দিল। সে আর টেবিলে বসে থাকতে পারল না। “আমার… আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে আম্মি, আমি পরে খাব,” বলে সে প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এল।
দরজা বন্ধ করে সে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। নিজের ঘরেও তার শান্তি নেই। ওই বন্ধ দরজাটা, ওই ভাঙা কাঁচের ফাটলটা যেন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওটা যেন তাকে ডাকছে, তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—তুমি যা দেখেছ, তা আর ভোলা যাবে না। তুমি এখন আর সেই নিষ্পাপ ছেলেটি নও। তুমি এখন গুনাহগার।
কয়েকটা দিন যেন ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। আমিরের মনে হলো, তার চারপাশে এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করল সেই রাতের স্মৃতিটা মন থেকে মুছে ফেলতে। জোহরের নামাজের পর সে দীর্ঘক্ষণ জায়নামাজে বসে তসবিহ পাঠ করল, আসরের পর কোরআন তিলাওয়াত করল। সে আল্লাহ্র কাছে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করল, “হে আল্লাহ, আমার মন থেকে এই নাপাক চিন্তা দূর করে দাও… আমাকে হেদায়েত দাও…”
কিন্তু তার বয়ঃসন্ধির চঞ্চল মন সেই দৃশ্যটাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। বরং সে যত জোর করে ভুলতে চাইছিল, দৃশ্যটা তত বেশি স্পষ্ট, তত বেশি জীবন্ত হয়ে তার মানসপটে ভেসে উঠছিল। সেক্স বা যৌনতা সম্পর্কে তার কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তার জ্ঞান বলতে ছিল কেবল স্কুলের টিফিনের ফাঁকে বন্ধুদের মুখে শোনা কিছু অস্পষ্ট, ফিসফিস করে বলা চটি (choti) বা পানু গল্পের (panu golpo) রগরগে বর্ণনা। কিন্তু সে রাতে সে যা দেখেছিল, তা কোনো গল্পের কাল্পনিক চরিত্র ছিল না; তা ছিল রক্ত-মাংসের বাস্তব। তার নিজেরই আব্বু-আম্মি, যাদের শরীরের ভাঁজ, ঘাম আর নিঃশ্বাসের শব্দ সে অনুভব করেছে। সেই বাস্তবতা তার কল্পনার জগতকে তছনছ করে দিয়েছিল।
এখন রাত নামলেই আমিরের বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করে। পড়ার টেবিলে বই খোলা থাকে, সামনে ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির নোটস, কিন্তু তার চোখ অক্ষরগুলোর ওপর দিয়ে শুধু পিছলে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন সজাগ হয়ে থাকে পাশের ঘরের নিস্তব্ধতার দিকে।
সে এখন আর ঘুমানোর চেষ্টা করে না। সে অপেক্ষা করে। একটা শব্দের জন্য।
রাত গভীর হয়। রাস্তার কুকুরের ডাক বা দূরের ট্রেনের হুইসেল মিলিয়ে যাওয়ার পর যে নিঝুম স্তব্ধতা নামে, সেই স্তব্ধতায় আমির কান পেতে বসে থাকে। তার কান খোঁজে সেই পরিচিত, নিষিদ্ধ শব্দটা—খাটের সেই পুরনো স্প্রিংয়ের ক্যাঁচ… ক্যাঁচ… আওয়াজ ।
নিজের এই অধঃপতন দেখে সে নিজেই শিউরে ওঠে। বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে তার ঘৃণা হয়। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বলে, ‘আমি একটা জানোয়ার হয়ে যাচ্ছি… একটা নোংরা পশু! ছিঃ! আমি কি আমার নিজের বাবা-মায়ের ওপর নজরদারি করছি?’
কিন্তু ঘৃণা যত তীব্র হয়, কৌতূহল ততই অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। অপরাধবোধ তাকে কুঁকড়ে দেয়, কিন্তু শরীরের ভেতরে জেগে ওঠা এক অচেনা ক্ষুধা তাকে আবার সেই ভাঙা কাঁচের ফুটোটার দিকে টেনে নিয়ে যায়। সে জানে এটা পাপ, সে জানে এটা ভুল, তবু সে অপেক্ষা করে—কখন শুরু হবে সেই নিষিদ্ধ নাটক, কখন সে আবার সেই অন্ধকার জগতের সাক্ষী হতে পারবে।
আর এক রাত। ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে। বাইরের রাস্তায় নিঝুম স্তব্ধতা, মাঝে মাঝে শুধু নৈশপ্রহরীর বাঁশির আওয়াজ সেই নিস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে যাচ্ছে। আমিরের ঘরের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে, কিন্তু তার সামনে খোলা বইয়ের পাতাগুলো বাতাসের তোড়ে ওল্টাচ্ছে, সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তার সমস্ত অস্তিত্ব, সমস্ত স্নায়ু যেন টানটান হয়ে অপেক্ষা করছে সেই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য। তার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, এক ধরণের অসুস্থ উত্তেজনা তার পেটের ভেতর পাক খাচ্ছে।
হঠাৎ… সেই শব্দ।
ক্যাঁচ… ক্যাঁচ…
শব্দটা খুব মৃদু, কিন্তু রাতের এই গভীর নির্জনতায় সেটা আমিরের কানে বজ্রপাতের মতো শোনাল। তার হৃৎস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল, তারপর দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করল। অন্যদিন হলে হয়তো সে বালিশ চাপা দিয়ে এই শব্দ থেকে পালানোর চেষ্টা করত, তসবিহ হাতে নিয়ে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ত। কিন্তু আজ রাতটা অন্যরকম। আজ তার মনের ভেতরের সেই অদৃশ্য দেওয়ালটা ভেঙে পড়েছে। আজ আর কোনো দ্বিধা নেই, কোনো পিছুটান নেই।
আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে, কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, কিন্তু তার পা দুটো যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে ওই নিষিদ্ধ দরজার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে জানে সে যা করতে যাচ্ছে তা ভুল, তা মহাপাপ, কিন্তু এক অদম্য কৌতূহল তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। সে যেন এক নেশাগ্রস্ত মানুষ, যে জানে বিষপান করলে মৃত্যু নিশ্চিত, তবুও সে সেই বিষের পেয়ালাটাই চুমুক দিয়ে শেষ করতে চায়।
সে পা টিপে টিপে, দম বন্ধ করে সেই পুরনো কাঠের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার বুকের ধড়ফড়ানি এত তীব্র যে মনে হচ্ছে পাঁজর ভেঙে হৃৎপিণ্ডটা বাইরে ছিটকে আসবে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার ফ্রেমটা ধরল। তারপর খুব সাবধানে, খুব সন্তর্পণে সেই ভাঙা কাঁচের ফুটোটার কাছে নিজের চোখটা নিয়ে গেল।
আজ ওপাশের দৃশ্যটা অন্যরকম। আজ ঘরের আলোটা একটু বেশি। হয়তো টেবিল ল্যাম্পের শেডটা একটু কাত করা, বা জানলা দিয়ে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোটা সরাসরি বিছানায় এসে পড়েছে। সেই আলোয় আমির যা দেখল, তাতে তার দম আটকে এল।
সে দেখল তার আব্বু—সেই রাশভারী, ধর্মপ্রাণ নাদিম সাহেব—তার আম্মির শরীরের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে অবস্থান করছেন। আজ আর কোনো অস্পষ্ট ছায়া নয়, আজ সব কিছু স্পষ্ট। নাদিমের পরনে কেবল একটা পাতলা গেঞ্জি, আর সুরাইয়ার শরীরটা চাদরের নিচে হলেও তার অবয়ব স্পষ্ট। আমির দেখল, তার বাবার বলিষ্ঠ হাতটা পরম আদরে, আবার একই সাথে এক ধরণের আদিম ক্ষুধায় তার মায়ের গলা আর কাঁধের সংযোগস্থলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সুরাইয়ার ফর্সা হাতটা নাদিমের মাথার চুলগুলো খামচে ধরে আছে। আমির স্পষ্ট দেখতে পেল তার মায়ের শরীরটা কেমন যেন অসহায়ভাবে কাঁপছে। সেটা কি ভয়ে? নাকি সুখে? সে বুঝতে পারল না। কিন্তু মায়ের ওই কাঁপা শরীরটা দেখে তার নিজের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসছিল নাদিমের ভারী, ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ। ‘হাঁ… হাঁ…’ সেই শব্দের সাথে মিশে ছিল সুরাইয়ার অস্ফুট, চাপা গোঙানি, যা আমির আগে কখনো শোনেনি। মনে হচ্ছিল তার মা কোনো এক গভীর ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছেন, আর তার বাবা তাকে সেই ঘোরের অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।
নাদিম হঠাৎ মুখ তুলে সুরাইয়ার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে কোনো স্নেহ ছিল না, ছিল কেবল এক গ্রাসকারী ক্ষুধা। তিনি নিচু হয়ে সুরাইয়ার গলায় কামড় বসালেন। সুরাইয়ার শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে উঠল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল একটা তীব্র ফিসফিসানি—”উহ্… নাদিম… আস্তে…”
আমিরের মনে হলো তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। সে যা দেখছে তা ভুল, তা হারাম, তা এক জঘন্য গুনাহ্। তার উচিত এক্ষুনি চোখ সরিয়ে নেওয়া, তوبة করা। কিন্তু সে পারল না। এক অদ্ভুত জাদুবলে সে সেখানে আটকে রইল। তার মনে হলো সে যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে।
আর ঠিক তখনই, তার নিজের শরীরের ভেতরে এক অদ্ভুত, অজানা পরিবর্তন শুরু হলো। এতদিন সে জানত এটা পাপ, এটা অন্যায়। কিন্তু আজ, নিজের বাবা-মাকে এই আদিম খেলায় মত্ত দেখে তার নিজের শরীরের কোনো এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেন জেগে উঠল। তার তলপেটে এক অদ্ভুত টান অনুভব করল সে, তার শ্বাসও বাবার মতোই ভারী হয়ে এল। ভয়ের সাথে মিশে গেল এক নিষিদ্ধ উত্তেজনা, ঘৃণার সাথে মিশে গেল এক তীব্র আকর্ষণ। সে বুঝতে পারল, সে আর সেই আগের আমির নেই। এই দৃশ্য তাকে বদলে দিয়েছে, তার ভেতরে জাগিয়ে দিয়েছে এক নতুন, ভয়ঙ্কর সত্তা।
দিনগুলো এখন আর আগের মতো নেই। সেই প্রথম রাতের বুক ধড়ফড়ানি, সেই প্রচণ্ড অপরাধবোধ—সবই যেন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। এখন আর সেই ভাঙা কাঁচের সামনে দাঁড়ালে আমিরের হাত-পা আগের মতো কাঁপে না। বিবেকের দংশন যে একেবারে নেই তা নয়, কিন্তু সেই দংশনের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তার দেখার তৃষ্ণা। ব্যাপারটা এখন আর আকস্মিক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটা তার প্রাত্যহিক জীবনের একটা অংশ, একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
আমির এখন বদলে গেছে। সেই চঞ্চল, হাসিখুশি ছেলেটা এখন কেমন যেন চুপচাপ, নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছে। স্কুলের টিফিনে বন্ধুরা যখন আড্ডা দেয়, আমির তখন একপাশে বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ক্রিকেট খেলার মাঠ তাকে আর টানে না। বিকেল হতে না হতেই সে এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করে। তার সমস্ত সত্তা কেবল সন্ধ্যার অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করে।
পড়াশোনার টেবিলটা এখন তার কাছে কেবলই একটা আড়াল। সামনে ফিজিক্স বা ম্যাথের মোটা বই খোলা থাকে ঠিকই, কিন্তু তার মগজে ঘোরে অন্য সমীকরণ। তার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে, ক্লাসে শিক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সে তোতলায়, কিন্তু তাতে তার কোনো বিকার নেই। তার জগত এখন সংকুচিত হয়ে কেবল ওই পাশের ঘরটুকুতে এসে ঠেকেছে।
সে এখন একটা রুটিন আবিষ্কার করে ফেলেছে। সে এখন বাড়ির আবহাওয়ার পূর্বাভাস পড়তে পারে। নাদিম সাহেবের মেজাজ, সুরাইয়ার কোনো বিশেষ রঙের শাড়ি পরা, কিংবা রাতের খাবারে বিশেষ কোনো আয়োজন—এই ছোট ছোট সংকেতগুলো দেখেই সে বুঝে যায়, আজ সেই রাত।
আজও ঠিক তেমনই এক রাত।
আমির তার পড়ার টেবিলে বসে আছে, কিন্তু কান পেতে আছে পাশের ঘরের দিকে। সে জানে, একটু পরেই আব্বু এশার নামাজ শেষ করে ঘরে ঢুকবেন। সে জানে, আম্মি দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করবেন। আর ঠিক তারপরেই শুরু হবে সেই নাটক, যার দর্শক কেবল সে একা।
সে শুনল, পাশের ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ—‘খট’।
সঙ্গে সঙ্গে আমিরের শরীরের ভেতর দিয়ে একটা বিদ্যুতের স্রোত বয়ে গেল। বই-খাতা সব পড়ে রইল। সে উঠে দাঁড়াল। তার চোখের তারায় এখন আর ভয় নেই, আছে এক গ্রাসকারী ক্ষুধা। সে ধীরপায়ে, নিঃশব্দে সেই পুরনো দরজার কাছে এগিয়ে গেল। কোনো দ্বিধা ছাড়াই সে তার চোখটা সেই অভ্যস্ত ফুটোটার সাথে সেট করে নিল।
ওপাশের ঘরটা এখন তার চেনা মঞ্চ। আলো-আঁধারিতে সে দেখল, নাদিম সাহেব বিছানায় বসে আছেন, আর সুরাইয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন। দৃশ্যটা খুব সাধারণ, কিন্তু আমিরের কাছে এটাই উত্তেজনার বারুদ। সে জানে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই শান্ত দৃশ্যটা বদলে যাবে ঝড়ে।
সে দেখল, নাদিম সাহেব উঠে গিয়ে সুরাইয়ার পেছনে দাঁড়ালেন। আয়নায় দুজনকে দেখা যাচ্ছে। আমির দেখল, তার বাবা পেছন থেকে তার মায়ের কোমরে হাত রাখলেন। সুরাইয়া একটুও চমকালেন না, বরং তিনি যেন এই স্পর্শের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মাথাটা একটু হেলিয়ে দিলেন স্বামীর কাঁধে।
আমিরের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে এই মুহূর্তটার জন্যই সারাটা দিন অপেক্ষা করেছে। সে দেখল, নাদিম সাহেব সুরাইয়ার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে গভীর ভাবে ঘ্রাণ নিচ্ছেন, যেন কোনো মাতাল করা সুগন্ধি ফুলের গন্ধ শুঁকছেন। আমিরের নিজের নাকের ডগাও যেন ফুলে উঠল, সে কল্পনা করার চেষ্টা করল—কেমন গন্ধ ওটা? ঘামের? পাউডারের? নাকি কামনার?
সে আর এখন ভাবে না যে এটা তার বাবা-মা। ওই ঘরের দুজন মানুষ এখন তার কাছে কেবলই দুটো শরীর, যারা তাকে এক অজানা সুখের সন্ধান দেয়। সে দেখল, নাদিম সাহেব সুরাইয়ার ব্লাউজের হুকগুলো খুলতে শুরু করেছেন। সুরাইয়ার পিঠের ফর্সা চামড়া ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হচ্ছে।
আমির তার পাজামার ওপর দিয়ে নিজের উরু খামচে ধরল। তার হৃৎপিণ্ডটা এখন একটা অদ্ভুত ছন্দে লাফাচ্ছে। সে জানে, একটু পরেই সেই পরিচিত ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ শুরু হবে, একটু পরেই তার মায়ের মুখ থেকে সেই চাপা গোঙানি বেরিয়ে আসবে। আর সেই শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে তার নিজের শরীরও এক চরম মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাবে। অপরাধবোধ এখন অতীত, এখন আছে কেবল এক অপ্রতিরোধ্য আসক্তি।
আমির এখন আর চোরের মতো পা টিপে আসে না, সে আসে অধিকার নিয়ে। দরজার সেই ভাঙা কাঁচের ফুটোটা এখন তার ব্যক্তিগত সিনেমা হলের জানালা। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে তার পাজামার ফিতাটা আলগা করে দিল, কারণ ভেতরে তখন দৃশ্যপট তৈরি হয়ে গেছে।
আজকের আলোটা আরও স্পষ্ট। আমির দেখল, নাদিম সাহেব তার লুঙ্গিটা পুরোপুরি সরিয়ে দিয়েছেন। আবছা আলোয় তার বাবার সেই উদ্যত, ইস্পাত-কঠিন বাঁড়াটা আমিরের চোখের সামনে দৃশ্যমান। সে দেখল, সুরাইয়া বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন, তার ফর্সা পা দুটো তিনি ভাজ করে দুদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যেন তার স্বামীকে তার ভেতরে প্রবেশ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। পঁয়ত্রিশ বছরের শরীর হলেও সুরাইয়ার যোনিপথটা আমিরের কাছে এখনো কুমারী মেয়েদের মতোই আঁটসাঁট মনে হলো। সে শ্বাস আটকে দেখল, নাদিম সাহেব তার বিশাল দণ্ডটা সুরাইয়ার গুদের মুখে স্থাপন করলেন। তারপর এক ধীর, কিন্তু নিশ্চিত চাপে সেটাকে ভেতরে ঠেলে দিলেন। সুরাইয়ার শরীরটা সেই চাপে শিউরে উঠল, তার পিঠটা বিছানা থেকে সামান্য উপরে উঠে এল। আমিরের মনে হলো, সে যেন নিজের শরীরেই সেই প্রবেশের চাপ অনুভব করতে পারছে ।
মিশনারি পজিশনে শুরু হলো সেই আদিম ছন্দ। নাদিম সাহেবের প্রতিটি ঠাপ যেন সুরাইয়ার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আমির দেখল তার বাবার চওড়া পিঠটা ওঠানামা করছে, আর তার নিচে তার মা পিষে যাচ্ছেন এক অদ্ভুত সুখে। কিছুক্ষণ পর নাদিম সাহেব থামলেন। তিনি সুরাইয়াকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন। সুরাইয়া বাধ্য স্ত্রীর মতো বিছানায় উপুড় হয়ে বসলেন, হাঁটু আর হাতের ওপর ভর দিয়ে। ডগি স্টাইল। নাদিম সাহেব পেছন থেকে তার স্ত্রীর নিতম্ব দুহাতে খামচে ধরলেন । এবার খেলাটা আরও বন্য হয়ে উঠল। পেছন থেকে সজোরে ঠাপ মারতে শুরু করলেন তিনি, আর সুরাইয়ার খোলা চুলগুলো দোলনার মতো দুলতে লাগল।
আমির আজ আর নিজের ঘরে পালিয়ে গেল না। সেই অন্ধকার বারান্দায়, দরজার ঠিক ওপাশেই সে দাঁড়িয়ে রইল। তার নিজের বাঁড়াটা তখন পাথরের মতো শক্ত হয়ে তার হাতে ধরা। সে তার বাবার ছন্দের সাথে তাল মেলাতে শুরু করল। ওপাশে নাদিম সাহেব যত জোরে ঠাপ দিচ্ছেন, এপাশে আমির ঠিক ততটাই দ্রুতগতিতে নিজের লিঙ্গ ঘর্ষণ করছে । ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে সুরাইয়ার চাপা শীৎকার—”উহ্… আঃ… নাদিম…”। সেই শব্দগুলো আমিরের কানে যেন তপ্ত লাভা ঢেলে দিচ্ছে। উত্তেজনায় তার নিজের গলা দিয়েও গোঙানি বেরিয়ে আসতে চাইল, কিন্তু সে নিজের বাম হাত দিয়ে নিজের মুখটা শক্ত করে চেপে ধরল, পাছে কোনো শব্দ বেরিয়ে গিয়ে এই নিষিদ্ধ নাটকটা নষ্ট করে দেয়। তার চোখ ফুটো থেকে একচুলও সরল না।
ওপাশে ঝড়টা এখন তুঙ্গে। নাদিম সাহেবের গতি এখন ঝড়ের মতো, বিছানাটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে আর্তনাদ করছে। আমির বুঝল সময় হয়ে এসেছে। সে দেখল তার বাবা সুরাইয়ার কোমড়টা শেষবারের মতো শক্ত করে চেপে ধরলেন এবং গভীর একটা ধাক্কা দিয়ে সুরাইয়ার ভেতরে স্থির হয়ে গেলেন। তিনি তার সবটুকু বীর্য সুরাইয়ার গুদের গভীরে ঢেলে দিচ্ছেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, এই পাশে দাঁড়িয়ে আমিরও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। তার শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল। দরজার সেই ফুটোয় চোখ রেখেই, বাবার চরম মুহূর্তটা দেখতে দেখতেই আমির তার নিজের গরম আঠালো মাল তার হাতের মুঠোয় আর প্যান্টের ওপর ছড়িয়ে দিল। দুপাশেই নেমে এল এক ভারী, ক্লান্ত নিস্তব্ধতা। হাঁপাতে হাঁপাতে আমির দেওয়ালে মাথা ঠেকাল। এই নোংরা, নিষিদ্ধ রুটিনটাই এখন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার প্রতি রাতের অভ্যাস।
স্কুল থেকে ফেরার পথে আমিরের মনে কোনো কুচিন্তা ছিল না। রোজকার মতোই সে ঘেমেনেয়ে, ক্লান্ত শরীরে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল। কিন্তু বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই সে থমকে গেল। অন্যদিন এই সময় বাড়িটা শান্ত থাকে, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে রান্নার শব্দ বা সুবাস। কিন্তু আজ বাড়িটা অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ, অথচ বসার ঘরে মানুষের জটলা।
আমির বসার ঘরে উঁকি দিল। সোফায় তার বাবা, ইমরান বসে আছেন। তার বসার ভঙ্গিটা অদ্ভুত—মেরুদণ্ড সোজা, দুই হাত কোলের ওপর স্থির, দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ। যেন এক পাথরের মূর্তি। তার আশেপাশে চাচা, মামা এবং কয়েকজন প্রতিবেশী নিচু স্বরে কথা বলছেন।
আমির কিছুই বুঝতে পারল না। তার বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। সে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামাতে নামাতে অস্ফুট স্বরে ডাকল, “আম্মি…?”
কেউ উত্তর দিল না। ঘরের বাতাস ভারী, থমথমে।
একজন আত্মীয়, সম্ভবত তার ছোট মামা, দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলেন। তার চোখ লাল, কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে রেখে আমিরের কাঁধে হাত রাখলেন। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, “আমির… শক্ত হও বাবা। তোমার আম্মি আর নেই।”
আমিরের মনে হলো, মামা কোনো ভিনগ্রহের ভাষায় কথা বলছেন। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
মামা আবার বললেন, “দুপুরে গোসল করতে গিয়েছিলেন… বাথরুমে পড়ে যান। ডাক্তার বলেছিল ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতালে নেওয়ার সময়টুকুও পাওয়া যায়নি।”
আমিরের হাত থেকে স্কুলের ব্যাগটা ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। তার মস্তিষ্কে শব্দগুলো ঢুকছে, কিন্তু অর্থ তৈরি করতে পারছে না। ‘গোসল করতে গিয়েছিলেন…’—এই শব্দটা তার মাথায় হাতুড়ির মতো আঘাত করল। গত রাতে সে যে শরীরটাকে দেখেছিল কামনার চাদরে মোড়ানো, জীবন্ত, স্পন্দিত—সেই শরীরটা আজ নিথর? বাথরুমের মেঝেতে পড়ে ছিল?
সে বাবার দিকে তাকাল। সে আশা করেছিল, ইমরানকে বিধ্বস্ত দেখবে, দেখবে তিনি প্রলাপ বকছেন বা কাঁদছেন। কিন্তু ইমরান ছিলেন সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। তার চোখে এক ফোঁটা জল নেই, মুখে কোনো যন্ত্রণার ছাপ নেই। তিনি বরং আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত, যেন তিনি কোনো ব্যবসায়িক সংকট মোকাবিলা করছেন।
ইমরান মুখ তুলে তাকালেন না, কিন্তু পাশের এক চাচার প্রশ্নের উত্তরে ধীর ও স্থির গলায় বললেন, “হ্যাঁ, আসরের নামাজের পরেই জানাজা হবে। কবরস্থানে লোক পাঠানো হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি। আপনারা শুধু কাফনের কাপড়টার ব্যবস্থা দেখুন।”
ইমরানের এই যান্ত্রিক, হিসেবি কথাবার্তা আমিরের কানে তীরের মতো বিঁধল। গত রাতে দরজার ফুটো দিয়ে সে যে ইমরানকে দেখেছিল—উন্মত্ত, কামাতুর, পশুর মতো ক্ষুধার্ত—তার সাথে এই মানুষটার কোনো মিল নেই। এই মানুষটা যেন আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া কোনো রোবট। তার স্ত্রী, যার সাথে কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি আদিম খেলায় মত্ত ছিলেন, তার মৃত্যুতে তিনি এতটাই ‘ওকে’ আছেন যে দাফনের লজিস্টিকস নিয়ে আলোচনা করছেন!
আমিরের শোকের জায়গাটা দখল করে নিল এক তীব্র বিভ্রান্তি আর অবিশ্বাসের বোধ। সে নিজেকেই প্রশ্ন করল, কাল রাতে সে যা দেখেছিল তা কি সত্যি ছিল? নাকি তার বাবা আসলেই এরকম পাথর? সে তার আম্মিকে শেষবার দেখার জন্যও পা বাড়াতে পারল না, শুধু বসার ঘরের এক কোণে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল, যেন সে এই নাটকের কোনো অংশই নয়।
সেই রাত। দাফন-কাফনের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর বাড়িটা এখন এক গভীর, দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। আত্মীয়-স্বজনরা যে যার মতো বিদায় নিয়েছে, বা দূরের আত্মীয়রা গেস্টরুমে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে আছে আগরবাতি আর গোলাপজলের এক ভারী, মিষ্টি কিন্তু বিষাদগ্রস্ত গন্ধ। এই গন্ধটা মৃত্যুর, এই গন্ধটা বিচ্ছেদের। কিন্তু আমিরের কাছে এই গন্ধটা আজ কেবলই এক পরিবর্তনের সংকেত।
আমির তার নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। তার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো চুইয়ে পড়ছে মেঝেতে, তৈরি করছে অদ্ভুত সব ছায়া। তার চোখের পাতা ভারী, শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মস্তিষ্ক সজাগ। আজ সারাদিন সে কেঁদেছে কি? না, সে কাঁদেনি। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে, নাকি তার অনুভূতির জায়গাটা ভোঁতা হয়ে গেছে, সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। তার মা, ফাতিমা, আজ নেই। তাকে মাটির নিচে রেখে আসা হয়েছে। এই সত্যটা তার মস্তিষ্কের কোনো এক লজিক্যাল কম্পার্টমেন্টে জমা হয়েছে, কিন্তু তার আবেগের দরজায় কড়া নাড়তে পারেনি।
কারণ, আমির এখন আর সেই সাধারণ ১৬ বছরের কিশোর নেই, যে তার মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়বে। সে এখন এক আসক্ত দর্শক, যার মনোজগত গত কয়েক মাসে পুরোপুরি বদলে গেছে। তার সত্তা এখন দুটো ভাগে বিভক্ত—একভাগে সে এক স্কুলছাত্র, আর অন্যভাগে সে এক গোপন লম্পট, যে প্রতি রাতে তার বাবা-মায়ের আদিম খেলার সাক্ষী থাকে।
ঘড়ির কাঁটা যখন রাত দুটোর ঘরে পৌঁছাল, ঠিক তখনই আমিরের ঘুম ভেঙে গেল। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে নয়, কোনো শোকের কারণে নয়। এটা ছিল তার শরীরবৃত্তীয় ঘড়ি-এর এক অমোঘ নির্দেশ। গত কয়েক মাস ধরে ঠিক এই সময়টাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। এটা এখন তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। তার শরীর জানে, এখন জেগে ওঠার সময়। এখন ‘শো’ শুরু হওয়ার সময়।
ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই তার ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে উঠল। সে বিছানায় মড়ার মতো স্থির হয়ে পড়ে রইল, কান পাতল পাশের ঘরের দেওয়ালের দিকে। তার মস্তিষ্ক অপেক্ষা করছে সেই পরিচিত শব্দটার জন্য—খাটের সেই পুরনো স্প্রিংয়ের ক্যাঁচ… ক্যাঁচ… ছন্দময় আওয়াজ। সে অপেক্ষা করছে তার মায়ের সেই চাপা, অস্ফুট শীৎকারের জন্য, যা তার রাতের নির্জনতাকে কামনার রঙে রাঙিয়ে দিত। সে অপেক্ষা করছে তার বাবার সেই ভারী, পশুর মতো নিঃশ্বাসের শব্দের জন্য।
কিন্তু আজ… কোনো শব্দ নেই।
বাড়িটা কবরের মতোই নিস্তব্ধ। পাশের ঘর থেকে কোনো নড়াচড়ার শব্দ আসছে না। কোনো ফিসফিসানি নেই, কোনো কাপড়ের খসখসানি নেই, কোনো ঘর্ষণের শব্দ নেই। আছে শুধু এক অখণ্ড, ভারী নীরবতা যা আমিরের কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।
এই নীরবতা আমিরকে স্বস্তি দিল না, বরং তাকে এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ফেলে দিল। তার শোক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার বদলে সে অনুভব করল এক তীব্র বিরক্তি। তার মনে হলো, কেউ যেন তার প্রাপ্য কিছু থেকে তাকে বঞ্চিত করছে। তার শরীরটা এক ধরণের ডোপামিনের জন্য অপেক্ষা করছিল, যা সে প্রতি রাতে পেত। সেই উত্তেজনা, সেই নিষিদ্ধ দৃশ্যের নেশা আজ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তার মনে একবারও এল না যে, তার মা আর বেঁচে নেই, তাই শব্দ আসা অসম্ভব। তার আসক্ত মন শুধু জানে—এখন সময় হয়েছে, কিন্তু ‘নাটক’ শুরু হচ্ছে না কেন?
আমিরের শরীরটা বিছানায় ছটফট করতে লাগল। তার হাত-পা নিশপিশ করছে। সে বুঝতে পারল, শুয়ে থেকে লাভ নেই। তার শরীর তাকে নির্দেশ দিচ্ছে উঠে গিয়ে দেখতে। তার মন তাকে বলছে, হয়তো শব্দ হচ্ছে না, কিন্তু দৃশ্যটা তো থাকতে পারে! হয়তো আজ তারা খুব নিঃশব্দে করছে? হয়তো আজ খেলাটা অন্যরকম?
এই অযৌক্তিক, বিকৃত আশা নিয়ে সে বিছানা ছাড়ল।
আমির তার ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে খুলল। দরজার কবজাগুলোতে সে আগেই তেল দিয়ে রেখেছিল, যাতে রাতে বেরোনোর সময় কোনো শব্দ না হয়। অন্ধকার করিডোরে পা রাখতেই তার পরিচিত শিহরণটা জাগল। কিন্তু আজকের শিহরণটা অন্যরকম। আজ বাতাসে কোনো উত্তাপ নেই, আছে কেবল হিমশীতল শূন্যতা।
সে পা টিপে টিপে সেই পুরনো সংযোগকারী দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। এই পথটা তার মুখস্থ। অন্ধকালেও সে জানে কোথায় মেঝের টাইলসটা একটু উঁচু, কোথায় পা দিলে শব্দ হবে না। সে যেন এক দক্ষ শিকারি, যে তার শিকারের ডেরার দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু আজ সে শিকারি নয়, আজ সে এক ক্ষুধার্ত ভিখারি, যে জানে না তার ভিক্ষার ঝুলি ভরবে কি না।
বাবা-মায়ের ঘরের দরজাটা আজ সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। হয়তো বাতাস চলাচলের জন্য, বা হয়তো মৃত্যুর পর গোপনীয়তার আর কোনো প্রয়োজন নেই বলে ইমরান ওটা ভেজিয়ে রাখেননি। কিন্তু আমির সেই ফাঁক দিয়ে দেখল না। তার অভ্যাস তাকে টেনে নিয়ে গেল সেই পুরনো, ভাঙা কাঁচের ফুটোটার কাছে। ওটাই তার লেন্স, ওটাই তার সিনেমা হলের পর্দা। ওখান দিয়ে দেখাটাই তার কাছে আসল উত্তেজনা।
সে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে। সে নিজেকে প্রস্তুত করল। তার হাতটা পাজামার ওপর দিয়ে নিজের গোপনাঙ্গের কাছে চলে গেল, যেমনটা প্রতি রাতে যায়। সে চোখ রাখল সেই ফুটোয়।
ওপাশের ঘরে একটা নিবু নিবু ডিম লাইট জ্বলছে। সেই ম্লান, হলুদ আলোয় ঘরটা এক ভৌতিক আকার ধারণ করেছে। আমির ফোকাস করার চেষ্টা করল। তার চোখ খুঁজল সেই খাটটা, যেখানে প্রতি রাতে ঝড় উঠত।
সে দেখল খাটটা। কিন্তু যা দেখল, তা তার সমস্ত উত্তেজনাকে এক মুহূর্তে জল করে দিল।
খাটটা খালি।
সেখানে কোনো নড়াচড়া নেই। কোনো শরীরের স্তূপ নেই। সাদা চাদরটা টানটান করে বিছানো, কোথাও কোনো কুঁচকানো নেই। বালিশ দুটো পাশাপাশি রাখা, কিন্তু তার ওপর কোনো মাথা নেই। গত রাতেও যেখানে সে দেখেছিল দুটো ঘর্মাক্ত শরীর একে অপরের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, যেখানে সে দেখেছিল তার বাবার পেশিবহুল পিঠ আর তার মায়ের ফর্সা, উন্মুক্ত উরু—সেখানে আজ কেবল এক বিশাল শূন্যতা।
ইমরান, তার বাবা, খাটে নেই। হয়তো তিনি গরমে মেঝেতে শুয়েছেন, বা হয়তো অন্য কোনো ঘরে। কিন্তু আমিরের চোখ খুঁজছিল ফাতিমাকে। সেই শরীরটাকে, যা তার রাতের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু সেই শরীরটা আজ নেই। সেটা আজ মাটির নিচে, অন্ধকারে, একলা।
আমিরের দৃষ্টি খাটের পায়াগুলোর দিকে গেল। ওগুলো আজ স্থির। স্প্রিংগুলো আজ নীরব। ঘরের বাতাসে আজ কামনার সেই তীব্র, নোনা গন্ধটা নেই। তার বদলে আছে ফিনাইল আর আগরবাতির গন্ধ। টেবিলের ওপর রাখা জলের জগ আর গ্লাসটা চকচক করছে ডিম লাইটের আলোয়। আয়নাটা, যাতে সে মাঝে মাঝে তাদের প্রতিবিম্ব দেখত, সেটা এখন কেবল খালি ঘরটার প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছে।
আমির লেন্সের মতো তার দৃষ্টিকে ঘরের প্রতিটি কোণায় ঘোরাল। কোথাও কিচ্ছু নেই। তার ‘শো’ আজ বন্ধ। শুধু আজ নয়, এই শো আর কোনোদিন হবে না। সিনেমার পর্দাটা ছিঁড়ে গেছে, প্রজেক্টরটা ভেঙে গেছে। তার আসক্তির উৎসটি (source)—তার মায়ের শরীর—এখন অস্তিত্বহীন।
আমির ফুটো থেকে চোখ সরিয়ে নিল। সে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার হাতটা এখনো পাজামার ওপর রাখা, কিন্তু তার হাতের নিচে কোনো সাড়া নেই। তার বাঁড়া (cock) একটুও শক্ত হয়নি। এতক্ষণ যে উত্তেজনা নিয়ে সে এসেছিল, যে অভ্যাসের বশে তার রক্ত গরম হয়ে উঠেছিল, সেই সব কিছু এক নিমেষে উবে গেছে।
সে নিজের দিকে তাকাল। একটা ১৬ বছরের ছেলে, অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে, তার মৃত মায়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে মাস্টারবেট করার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিল—এই নগ্ন সত্যটা তাকে মুহূর্তের জন্য হলেও ধাক্কা দিল। কিন্তু সেই ধাক্কায় কোনো কান্না এল না, কোনো অনুশোচনা এল না। এল কেবল এক গভীর হতাশা।
তার মনে হলো, সে যেন এক নেশাখোর, যে অনেক কষ্ট করে ডিলারের কাছে এসে দেখল দোকান বন্ধ। তার মাল নেই, তাই তার নেশাও হচ্ছে না।
সে ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে ফিরল। তার হাটাচলায় কোনো শক্তি নেই। বিছানায় এসে যখন সে আবার শুয়ে পড়ল, তখন তার মনে হলো তার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। এই শূন্যতা মায়ের জন্য শোকের শূন্যতা নয়। এটা এক বিনোদন হারানোর শূন্যতা। এটা এক গোপন জগত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শূন্যতা।
আমির সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার জীবনের সবচেয়ে বড় গোপন রহস্যটার ওপর আজ যবনিকা পড়ল।
