স্বামীর দান, শ্বশুরের অধিকার 3

5
(1)

অফিস এখন আর আমিরের কাছে কেবল কাজের জায়গা নয়, এটা এখন তার ভালোবাসারও ঠিকানা। প্রতিদিন সকালে তারা একসাথেই ফ্ল্যাট থেকে বের হয়। আমিরের বাইকের পেছনে বসে সারা, তার হাতদুটো আমিরের কোমরের দুপাশে শক্ত করে জড়ানো। ট্রাফিক সিগন্যালে যখন গাড়ি দাঁড়ায়, সারা আলতো করে তার থুতনিটা আমিরের কাঁধে ঠেকিয়ে রাখে। অফিস শেষ হওয়ার পর লিফটের সামনে তারা আবার এক হয়। কলিগরা এখন আর আড়ালে ফিসফিস করে না, তারা বরং এই জুটিটাকে দেখে মুচকি হাসে।

ক্যান্টিনের দুপুরের দৃশ্যটা এখন অফিসের একটা চেনা ছবি। আমির আর সারা এখন আর আলাদা টেবিলে বসে না, এমনকি আলাদা প্লেটেও খায় না। এক প্লেট বিরিয়ানি বা মশালা ধোসা, আর দুটো চামচ। সারা যখন নিজের হাতে এক চামচ খাবার আমিরের মুখে তুলে দেয়, তখন আমিরের মনে হয় তার ছোটবেলার সেই একাকী টিফিন পিরিয়ডগুলোর সমস্ত বঞ্চনা মিটে যাচ্ছে।

সপ্তাহান্তের সন্ধ্যাগুলো কাটে মাল্টিপ্লেক্সের অন্ধকারে। পিভিআর বা আইম্যাক্সের বিশাল স্ক্রিনে সিনেমা চলে, কিন্তু আমিরের মনোযোগ থাকে তার পাশে বসা মানুষটার দিকে। ছোটবেলায় অন্ধকার মানেই ছিল আমিরের কাছে এক নিষিদ্ধ উত্তেজনা, এক পাপবোধ। কিন্তু এখন এই সিনেমা হলের অন্ধকারে সে খুঁজে পায় নিরাপত্তা। কোনো যৌনতা নয়, কোনো নোংরা স্পর্শ নয়। তারা কেবল একে অপরের হাত ধরে বসে থাকে। সারার মাথাটা আমিরের কাঁধে রাখা, আমিরের আঙুলগুলো সারার আঙুলের ফাঁকে। এই স্পর্শে কোনো কামনার আগুন নেই, আছে এক স্নিগ্ধ উষ্ণতা।

দিনগুলো এভাবেই কাটছিল, কিন্তু একটা ছোট লজিস্টিক্যাল সমস্যা তাদের সম্পর্কটাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল।

সেদিন শুক্রবার সন্ধ্যা। তারা আমিরের ফ্ল্যাটের লিভিং রুমে বসে পিৎজা খাচ্ছিল। সারাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

“কী হয়েছে?” আমির জিজ্ঞেস করল।

সারা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল, “আমির, আমার পিজি (PG)-র সাথে চুক্তিটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ল্যান্ডলেডি আজ সকালে নোটিশ দিয়েছে, ওটা রিনভেশন করবে। আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে রুম খালি করতে হবে।”

আমির খাওয়া থামিয়ে দিল। “তো? নতুন পিজি খুঁজবে?”

সারা একটু ইতস্তত করল। সে আমিরের চোখের দিকে তাকাল। “আর এক মাস পরেই তো আমাদের বিয়ে, তাই না? এখন আবার নতুন পিজি খোঁজা, ডিপোজিট দেওয়া, শিফট করা… অনেক ঝামেলা। আমি ভাবছিলাম…” সে থামল, আমিরের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করল।

“কী ভাবছিলে?”

“আমি কি… মানে, আমার জিনিসপত্রগুলো তোমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসব? এই কটা দিন এখানেই থাকলাম। বিয়ের পর তো এমনিতেও এখানেই থাকব।”

আমির এক মুহূর্তের জন্য ভাবল। তাদের দুজনের পরিবারই রক্ষণশীল। বিয়ের আগে এভাবে একসাথে থাকাটা তাদের সমাজে খুব একটা সহজভাবে দেখা হয় না। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনে হলো, তারা তো এখন ব্যাঙ্গালোরে। এখানে কেউ তাদের জাজ করবে না। আর তাছাড়া, তাদের বিয়ে তো ঠিক হয়েই গেছে।

আমির হাসল, এক উদার হাসি। “অবশ্যই। এটা তো তোমারও ফ্ল্যাট। তুমি কালই চলে এসো। আমি গাড়ি নিয়ে যাব।”

পরের দিনই সারার দুটো বড় সুটকেস আর কয়েকটা কার্টন আমিরের ফ্ল্যাটে জায়গা করে নিল। আমিরের ব্যাচেলর ফ্ল্যাটটা চোখের পলকে বদলে গেল। বাথরুমে এখন আমিরের শেভিং কিটের পাশে সারার শ্যাম্পু আর ফেসওয়াশ। আলমারির অর্ধেকটা এখন সারার রঙিন জামাকাপড়ে ভর্তি। রান্নাঘরে নতুন সব মশলার কৌটো। তারা এখন লিভ-ইন (Live-in) করছে। সমাজের চোখে এটা হয়তো নিয়মবহির্ভূত, কিন্তু তাদের এই আধুনিক, কর্মব্যস্ত জীবনে এটাই হয়ে উঠল সবচেয়ে স্বাভাবিক এবং আরামদায়ক ব্যবস্থা।

এক ছাদের নিচে থাকার ফলে তাদের সম্পর্কের সমীকরণটা আরও গভীর হলো। অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা যখন সোফায় এলিয়ে দেয়, তখন একে অপরের সান্নিধ্যই তাদের একমাত্র ওষুধ হয়ে দাঁড়ায়।

এখন আর সেক্স কোনো বিশেষ ‘ইভেন্ট’ বা ‘ঘটনা’ নয়। এটা তাদের দৈনন্দিন রুটিনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাতের খাবার খাওয়ার পর, বা কখনো কখনো অফিস যাওয়ার আগে সকালে, তাদের শরীরগুলো অভ্যাসের বশে একে অপরকে খুঁজে নেয়।

তবে এই রুটিনের মধ্যে একটা বিশেষ দিক ছিল, যা তাদের সম্পর্কের গভীরতাকে নির্দেশ করত। তাদের মিলন সবসময়ই হতো “আনপ্রোটেক্টেড” (unprotected)।

প্রথমবার যখন সারা কনডমের কথা জিজ্ঞেস করেছিল এবং আমির ‘না’ বলেছিল, তারপর থেকে আর কোনোদিন এই প্রসঙ্গ ওঠেনি। এটা যেন তাদের মধ্যে এক অকথিত (unspoken) চুক্তিতে পরিণত হয়েছিল। যেহেতু বিয়ে ঠিক হয়েই গেছে, তাই আর বাধার কী প্রয়োজন?

প্রতি রাতে, বা যেদিনই তারা মিলিত হতো, আমির তার পৌরুষের শেষ বিন্দু পর্যন্ত সারার ভেতরেই স্খলন করত।

দৃশ্যটা এখন আমিরের কাছে খুব স্বাভাবিক। মিশনারি হোক বা অন্য কোনো ভঙ্গি, শেষ মুহূর্তটা সবসময় একই রকম। আমির সারার শরীরের গভীরে প্রবেশ করে, তার কোমড়টা শক্ত করে ধরে রাখে, আর অনুভব করে তার গরম বীর্য কীভাবে সারার জরায়ুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সারাও তাকে বাধা দেয় না, বরং সে আমিরের পিঠ খামচে ধরে তাকে আরও গভীরে টেনে নেয়, যেন সে আমিরের প্রতিটি ফোঁটা নিজের ভেতরে ধারণ করতে চায়।

এই unprotected সেক্স তাদের কাছে এক ধরণের অধিকারের প্রতীক। এটা প্রমাণ করে যে তারা একে অপরের কতটা আপন। আমির যখনই স্খলন করে, তার মনে হয় সে সারাকে নিজের অংশ দিয়ে পূর্ণ করে দিচ্ছে। আর সারা যখন সেই বীর্য নিজের ভেতরে ধারণ করে শান্ত হয়ে শুয়ে থাকে, তখন তাদের মনে হয় তারা যেন ইতিমধ্যেই স্বামী-স্ত্রী।

মাসখানেক এভাবেই কাটল। তারা এখন “ম্যাডলি ইন লাভ”। জীবনটা আমিরের কাছে একটা নিখুঁত ছবির মতো। সকালে কফির মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়ানো, একসাথে অফিস যাওয়া, রাতে একে অপরের বাহুবন্ধনে ঘুমিয়ে পড়া—এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারে সে?

এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা এখন আর কেবল ইঁট-কাঠ-পাথরের খাঁচা নয়, এটা এখন একটা জীবন্ত সংসারের প্রতিচ্ছবি। নিকাহ্-এর আর মাত্র তিন মাস বাকি, কিন্তু সামাজিক সিলমোহরের অপেক্ষা না করেই আমির আর সারা নিজেদের একাত্ম করে নিয়েছে। তাদের জীবনটা এখন একটা নিখুঁত ছন্দে বাঁধা, যেখানে প্রতিটি সুর, প্রতিটি তাল একে অপরের পরিপূরক।

সকালবেলাটা শুরু হয় এক অদ্ভুত ব্যস্ততার মাধুর্য দিয়ে। এলার্ম বাজার আগেই আমিরের ঘুম ভেঙে যায়, সে পাশ ফিরে দেখে সারা তার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সারার খোলা চুলগুলো আমিরের গলায়, কাঁধে ছড়িয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা আমিরের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। সে আলতো করে সারার কপালে একটা চুমু খায়, তারপর খুব সাবধানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা ছাড়ে। কফি মেকারের শোঁ শোঁ আওয়াজে যখন সারাড় ঘুম ভাঙ্গে, তখন আমির ধোঁয়া ওঠা মগ হাতে বেডরুমে ঢোকে। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তাদের সম্পর্কটাকে মজবুত করেছে।

অফিস যাওয়াটা তাদের কাছে একটা রোমান্টিক অভিযানের মতো। আমির তার রয়্যাল এনফিল্ড বাইকটা বের করে, সারা তৈরি হয়ে নিচে নামে। লিফটে নামার সময়টুকুও তারা নষ্ট করে না, একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, কখনো বা আমির আলতো করে সারার হাতটা ছুঁয়ে দেয়। বাইকে যখন তারা “going office together” (একসাথে অফিসে যায়), তখন সারার হাতদুটো আমিরের কোমরের দুপাশে শক্ত করে জড়ানো থাকে। ব্যাঙ্গালোরের কুখ্যাত ট্রাফিক জ্যামও তখন আর বিরক্তিকর মনে হয় না। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকার সময় সারা তার থুতনিটা আমিরের কাঁধে ঠেকিয়ে রাখে, কখনো বা হেলমেটের কাঁচের ওপর দিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে। তাদের এই যুগলবন্দী এখন অফিসের কলিগদের কাছেও ঈর্ষার বিষয়।

অফিস শেষে ফেরার পথটাও একসাথেই। মাঝে মাঝে তারা সুপারমার্কেটে থামে। ট্রলি ঠেলে ঠেলে সংসারের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কেনাকাটা করে। কোনটা ভালো ডিটারজেন্ট, কোন ব্র্যান্ডের আটা ভালো—এসব নিয়ে তাদের খুনসুটি হয়। এই সাধারণ গার্হস্থ্য জীবনটাই আমিরের কাছে একসময় অকল্পনীয় ছিল। সে ভাবত তার জীবনটা কেটে যাবে একাকীত্বে, সেই পুরনো বাড়ির অন্ধকার স্মৃতির ভারে। কিন্তু সারা তাকে সেই গর্ত থেকে টেনে তুলেছে।

সপ্তাহান্তের দিনগুলো তাদের একান্ত নিজস্ব। তারা প্রায়ই মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যায় (“go cinema”)। হলের অন্ধকারে বসে তারা পপকর্ন শেয়ার করে, কিন্তু আমিরের মনোযোগ পর্দার চেয়ে বেশি থাকে তার পাশের মানুষটার দিকে। সে সারার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে রাখে, বুড়ো আঙুল দিয়ে সারার হাতের তালুতে আলতো করে ঘষতে থাকে। এই স্পর্শে কোনো লোলুপতা নেই, আছে এক গভীর প্রশান্তি। সিনেমা শেষে তারা লং ড্রাইভে যায়, কিংবা কোনো নতুন রেস্তোরাঁয় ডিনার করে। তাদের জীবনটা এতটাই নিখুঁত এবং স্বাভাবিক যে, মাঝে মাঝে আমিরের নিজেরই ভয় হয়—এটা কি সত্যি? নাকি কোনো সুখের স্বপ্ন?

তাদের এই সুখের সংসারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাদের শারীরিক সম্পর্ক। এটা এখন আর কোনো নিষিদ্ধ উত্তেজনা বা চুরিপনা নয়। এটা তাদের ভালোবাসার এক স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। দিনের শেষে, সমস্ত ক্লান্তি ধুয়েমুছে যখন তারা বিছানায় আসে, তখন দুটি শরীর চুম্বকের মতো একে অপরকে কাছে টানে। তাদের মিলনে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আছে একে অপরকে চিনে নেওয়ার, বুঝে নেওয়ার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

আমির এখন জানে সারার শরীরের কোন ভঁজে স্পর্শ করলে সে শিউরে ওঠে, কোথায় চুমু খেলে তার মুখ দিয়ে সেই মিষ্টি গোঙানি বেরিয়ে আসে। সারাও জানে আমিরের দুর্বলতাগুলো। তবে তাদের এই যৌনতার মধ্যে একটা বিশেষ দিক আছে, যা তাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলেছে। তারা কখনো কোনো প্রোটেকশন ব্যবহার করে না। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো আলাদা করে কথা হয়নি, যেন এটা এক অকথিত চুক্তি। আমির প্রতিবার মিলনের চরম মুহূর্তে তার পৌরুষের সমস্ত নির্যাস, সমস্ত ভালোবাসা সারার শরীরের গভীরে, তার জরায়ুর মুখে ঢেলে দেয়। আনপ্রোটেক্টেড (unprotected) সেক্স তাদের কাছে কেবল শারীরিক তৃপ্তি নয়, এটা এক ধরণের অধিকার বোধের প্রতীক। আমির যখনই সারার ভেতরে স্খলন করে, তার মনে হয় সে সারাকে নিজের অংশ দিয়ে পূর্ণ করে দিচ্ছে, তাকে নিজের করে নিচ্ছে। আর সারাও সেই উষ্ণ তরলকে নিজের ভেতরে ধারণ করে পরম তৃপ্তিতে আমিরের বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। এই ব্যাপারটা তাদের কাছে এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, এটাকে তারা তাদের ভালোবাসার রুটিন হিসেবেই মেনে নিয়েছে।

দিনগুলো এভাবেই কাটছিল, প্রেমের জোয়ারে ভাসা দুটি মানুষের মতো। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম বড় বিচিত্র। সে সব সময়ই নিখুঁত ছবির ক্যানভাসে কোথাও না কোথাও একটা ছোট আঁচড় কেটে দেয়।

সেটা ছিল এক রবিবারের অলস সকাল। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। ফ্ল্যাটের ভেতরে এসি চলছে না, জানলা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসেই ঘরটা মনোরম হয়ে আছে। আমির সোফায় বসে ল্যাপটপে একটা ওয়েব সিরিজ দেখছিল, হাতে কফির মগ। সারা তার পাশে বসে ফোনে কিছু একটা করছে।

আমির আড়চোখে তাকাল। দেখল, সারা তার ফোনের একটা অ্যাপে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু টাইপ করছে। স্ক্রিনের আলোয় তার মুখটা উজ্জ্বল। অ্যাপটার ইন্টারফেস দেখে আমির বুঝতে পারল ওটা একটা পিরিয়ড ট্র্যাকার। নারীরা সাধারণত তাদের মাসিক চক্রের হিসাব রাখার জন্য এটা ব্যবহার করে।

সারা স্ক্রিনে ক্যালেন্ডারের একটা তারিখে ট্যাপ করল, তারপর একটা ছোট নোট লিখল। তার মুখে কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ নেই, বরং একটা রুটিন কাজের মতো নির্লিপ্ত ভঙ্গি। সে ফোনটা লক করে পাশে রেখে দিল এবং আবার আমিরের কাঁধে মাথা রেখে টিভি দেখায় মন দিল।

কিন্তু আমিরের মনটা আর ওয়েব সিরিজে রইল না। তার মস্তিষ্কের ভেতরে একটা ছোট খটকা, একটা প্রশ্ন পোকার মতো নড়েচড়ে উঠল। সে কফির মগে চুমুক দিল, কিন্তু কফির স্বাদটা তার কাছে পানসে লাগল। তার দৃষ্টি বারবার চলে যাচ্ছিল টিপয়ের ওপর রাখা সারার ফোনটার দিকে।

আমিরের মস্তিষ্কে একটা অঙ্ক চলতে শুরু করল। সে ভাবল, তারা প্রায় তিন মাস ধরে একসাথে আছে। লিভ-ইন করছে। এই তিন মাসে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে অসংখ্যবার। সপ্তাহে অন্তত তিন-চারদিন, কখনো বা তারও বেশি। এবং প্রতিবার, প্রতিটি মিলনে, সে সারার ভেতরেই স্খলন করেছে। তারা কোনোদিন কোনো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করেনি, না পিল, না কনডম।

‘প্রায় তিন মাস হতে চলল…’ আমিরের মনের ভেতর একটা মনোলগ শুরু হলো। ‘আমরা একদিনও প্রোটেকশন নিইনি। আমি প্রতিবার ওর ভেতরে… আর সারা? সারার পিরিয়ড তো প্রতি মাসেই টাইম-টু-টাইম হচ্ছে। ও তো অ্যাপে সেটাই নোট করছিল। তার মানে… এই মাসেও ওর পিরিয়ড হয়েছে বা হবে।’

আমির নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘এটা কি স্বাভাবিক? আমি বায়োলজি খুব ভালো জানি না, কিন্তু সাধারণ জ্ঞান বলে, এত ঘন ঘন এবং নিয়মিত আনপ্রোটেক্টেড সেক্স করলে তো এতদিনে কনসিভ করার কথা ছিল। অন্তত একটা মিসড পিরিয়ড, বা মর্নিং সিকনেস… কিছু একটা তো হওয়ার কথা ছিল।’

তার মনে কোনো ভয় এল না, কোনো অভিযোগও তৈরি হলো না। সারার প্রতি তার ভালোবাসায় কোনো কমতি হলো না। প্রশ্নটা ছিল সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক। তারা দুজনেই তরুণ, দুজনেই সুস্থ। সারার শরীরে কোনো সমস্যা নেই, সে ফিট, অ্যাক্টিভ। তাহলে?

আমির সারার দিকে তাকাল। সারা নিশ্চিন্তে টিভি দেখছে, মাঝে মাঝে হাসছে। তার মধ্যে কোনো উদ্বেগ নেই। সে হয়তো ভাবছে, বিয়ে তো এখনো হয়নি, তাই এখনই বাচ্চা না হওয়াটাই ভালো। কিন্তু আমিরের পুরুষ মন, যে কিনা নিজের সক্ষমতা নিয়ে অবচেতনভাবে সর্বদা সচেতন থাকে, সে একটা সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করল।

‘এতদিনে তো… কিছু একটা হওয়ার কথা ছিল…’ এই চিন্তাটা তাকে আর শান্তি দিল না। সে জোর করে টিভি দেখায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মনের পেছনের দিকে ওই সন্দেহটা একটা ছোট বীজের মতো পুঁতে গেল।

সেদিন সারাটা দিন আমির একটু অন্যমনস্ক হয়ে রইল। সে বারবার ইন্টারনেটে সার্চ করল—”chances of pregnancy without protection in 3 months”, “fertility window”, “reasons for not conceiving naturally”। গুগল তাকে নানা রকম পরিসংখ্যান দিল। কেউ বলল এটা স্বাভাবিক, এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কেউ বলল, লাইফস্টাইল, স্ট্রেস এসব কারণ হতে পারে।

রাত হলো। ডিনারের পর তারা বিছানায় গেল। বেডরুমের নীলচে নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে। এসি-র মৃদু গুঞ্জন ঘরটাকে শান্ত করে রেখেছে। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। আজ তাদের মধ্যে মিলন হয়নি, শুধু নিছকই আদর আর খুনসুটি। সারার মাথাটা আমিরের বুকের ওপর, তার হাতটা আমিরের গেঞ্জির ভেতরে পিঠের ওপর রাখা।

আমির ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার বুকের ওপর সারার নিঃশ্বাসের ওঠানামা সে টের পাচ্ছে। পরিবেশটা এতটাই নিরাপদ আর আপন যে, যেকোনো কথা বলা যায়। এখানে কোনো গোপনীয়তার প্রয়োজন নেই।

আমির একটা বড় শ্বাস নিল। সে সিদ্ধান্ত নিল, কথাটা পেটে চেপে রেখে লাভ নেই। সারা তার জীবনের অংশ, তার সঙ্গেই এটা শেয়ার করা উচিত।

“সারা…” আমির খুব শান্তভাবে ডাকল, যেন সে অফিসের কোনো সাধারণ প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছে।

সারা ঘুমের ঘোরেই উত্তর দিল, “হুম? বলো।”

“একটা কথা ভাবছিলাম…” আমির একটু সময় নিল, শব্দগুলো গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। “উইয়ার্ড লাগতে পারে, কিন্তু বিষয়টা আমার মাথায় ঘুরছে সকাল থেকে।”

সারা এবার একটু নড়েচড়ে উঠল। সে আমিরের বুক থেকে মাথাটা তুলে তার মুখের দিকে তাকাল। তার চোখে ঘুম আর কৌতূহল মেশানো। “কী বিষয়? সিরিয়াস কিছু?”

আমির হাসল, তাকে আশ্বস্ত করার জন্য। “না না, সিরিয়াস কিছু না। আসলে… আমরা তো এখন একসাথেই আছি, হাজব্যান্ড-ওয়াইফের মতোই। আর আমাদের রিলেশনটাও…” সে একটু থামল, তারপর সরাসরি বলল, “মানে, আমরা তো কোনো প্রোটেকশন ইউজ করছি না। গত তিন মাস ধরে।”

সারা চুপ করে রইল, আমিরের কথাগুলো প্রসেস করছে।

আমির আবার বলল, “এতদিনে… মানে, আমি বলতে চাইছি, তোমার কি মনে হয় না… একটা ‘খবর’ আসার কথা ছিল? মানে, ন্যাচারালি? আমরা তো কোনো প্রিকশন নিইনি।”

সারা কিছুক্ষণ আমিরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সে ধীরে ধীরে শোয়া থেকে উঠে বসল। বালিশে হেলান দিয়ে সে চিন্তিত মুখে বলল, “জানো আমির, আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলাম গত কয়েকদিন ধরে। আজ সকালেই আমি আমার অ্যাপটা চেক করছিলাম। আমার পিরিয়ড ডেট আর দুই দিন পর। আর অ্যাপ বলছে, এই মাসেও পিরিয়ড টাইমেই হবে, কোনো ডিলে হওয়ার লক্ষণ নেই।”

“তাই?” আমিরও উঠে বসল। “তার মানে এই মাসেও কিছু হলো না।”

“না,” সারা মাথা নাড়ল। “দেখো, আমরা তো বিয়ের আগে প্ল্যান করে বাচ্চা নিচ্ছি না, তাই আমি ওটা নিয়ে খুব একটা প্যানিক করিনি। কিন্তু তুমি যখন বললে… লজিক্যালি তো ঠিকই। আমরা তো সাবধানে থাকিনি। তাহলে কনসিভ হলো না কেন?”

“সেটাই,” আমির বলল। “হতে পারে স্ট্রেস, বা কাজের চাপ, অথবা আমরা হয়তো ঠিক টাইমিংয়ে… মানে ওভুলেশন পিরিয়ডটা মিস করছি।”

“হতে পারে,” সারা একমত হলো। “তবে আমার মনে হয়, আমাদের লাইফস্টাইলটাও একটা ফ্যাক্টর হতে পারে। বাইরের খাবার, রাত জাগা…”

আমির সারার হাতটা ধরল। “তবুও, মনের শান্তির জন্য… আমাদের কি একবার ডক্টরের সাথে কথা বলা উচিত? জাস্ট… একটা রুটিন চেকআপ? সামনেই বিয়ে, তার আগে একটা প্রি-ম্যারিটাল হেলথ চেকআপ করিয়ে নেওয়া তো ভালোই। কী বলো?”

সারা আমিরের দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাসিটা চিন্তামুক্ত। সে এটাকে কোনো বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে না, বরং একটা দায়িত্বশীল দম্পতির সচেতন সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখছে। “হ্যাঁ, তাই ভালো। অহেতুক গুগল করে টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই। একটা টেস্ট করিয়ে নিই। সব ঠিক থাকলে আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম। আমি কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেব। কোরামঙ্গলাতেই একটা ভালো ফার্টিলিটি ক্লিনিক আছে, আমার কলিগ সাজেস্ট করেছিল।”

“গুড,” আমির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “তাহলে কালই। অফিস থেকে আর্লি বেরিয়ে যাব।”

“ওকে,” সারা আবার আমিরের বুকে মাথা রাখল। “এখন ঘুমাও। ওসব নিয়ে বেশি ভেবো না। যা হওয়ার হবে।”

আমির সারাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। তার মনে হলো, তারা কত পরিণত। যেকোনো সমস্যা তারা আলোচনা করে সমাধান করে নিতে পারে। এই চেকআপটা তো শুধু একটা ফরম্যালিটি। ডাক্তার হয়তো বলবেন ভিটামিন খেতে, বা লাইফস্টাইল একটু চেঞ্জ করতে। ব্যাস, এটুকুই।

ব্যাঙ্গালোরের কোরামঙ্গলার সেই আধুনিক ফার্টিলিটি ক্লিনিকটা আজ আমিরের কাছে কোনো হাসপাতালের মতো মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল এক বিচারালয়। ঝকঝকে কাঁচের দরজা, সেন্ট্রাল এসির হিমশীতল বাতাস, আর ওয়েটিং রুমের নরম সোফা—সব কিছুতেই এক ধরণের যান্ত্রিক আভিজাত্য। কিন্তু এই আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে হাজারো দম্পতির দীর্ঘশ্বাস, আশা আর হতাশার গল্প। সপ্তাহান্ত বলে আজ ভিড়টা একটু বেশি। তাদের মতো আরও অনেক দম্পতি বসে আছে, কারোর চোখে আশা, কারোর চোখে ক্লান্তি।

আমির আর সারা পাশাপাশি বসে ছিল। সারার হাতটা আমিরের হাতের মুঠোয় ধরা। আমিরের হাতের তালুটা সামান্য ঘামছে, কিন্তু সেটা ভয়ের কারণে নয়, বরং উত্তেজনায়। সে আত্মবিশ্বাসী। কেনই বা হবে না? গত তিন মাস ধরে সে তো কম ‘পরিশ্রম’ করেনি। প্রতি রাতে, বা যেদিনই সুযোগ পেয়েছে, সে তো তার পৌরুষের প্রমাণ দিয়ে এসেছে। তার মনে পড়ল সেই রাতগুলোর কথা, যখন সে সারার গুদের গভীরে তার উত্তপ্ত বাঁড়াটা গেঁথে দিত। সে অনুভব করত তার শক্ত দণ্ডটা কীভাবে সারার যোনিপথের মাংসল দেওয়ালগুলোকে ঘঁষে ঘঁষে ভেতরে ঢুকছে। আর শেষে? শেষে সে তো এক ফোঁটাও মাল বাইরে ফেলেনি। সে তো তার বিচি নিংড়ে সবটুকু সাদা আঠালো রস সারার বাচ্ছাদানিতে ঢেলে দিয়েছে। তার মাল তো জলের মতো পাতলা নয়, বেশ ঘন। সে দেখেছে, মিলনের পর সারা যখন বাথরুমে যেত, তখন তার উরু বেয়ে সেই মালের কিছুটা অংশ গড়িয়ে পড়ত। এত সব কিছুর পর রিপোর্টে কোনো সমস্যা থাকার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।

তার মনে হলো, ডাক্তার হয়তো বলবে, “সব ঠিক আছে, মিস্টার আমির। জাস্ট রিল্যাক্স করুন, বেশি করে প্রোটিন খান, আর সেক্সের সময় টাইমিংটা ঠিক রাখুন।” আমির মনে মনে হাসল। টাইমিং? টাইমিং তো তার বরাবরই ভালো। সে তো জানে কীভাবে সারাকে উত্তেজিত করতে হয়, কীভাবে তার গুদের জল খসাতে হয়।

নার্স এসে নাম ডাকল, “মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মালিক? ডাক্তারবাবু ডাকছেন।”

আমির আর সারা উঠে দাঁড়াল। সারার হাতটা এখন একটু বেশিই ঠান্ডা। আমির তার হাতে একটা মৃদু চাপ দিল, যেন বলতে চাইল, “ভয় নেই, আমি আছি।” তারা ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকল।

ডাক্তার রাও একজন মধ্যবয়সী, গম্ভীর মানুষ। তার চোখের চশমাটা বেশ মোটা, কিন্তু তার দৃষ্টিটা তীক্ষ্ণ। তিনি কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তাদের দিকে তাকালেন, তারপর ইশারা করলেন বসতে। তার সামনের টেবিলে দুটো ফাইল রাখা।

ডাক্তার রাও ফাইল দুটো খুললেন। ঘরের ভেতরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। আমিরের মনে হলো, এসির শোঁ শোঁ আওয়াজটাও যেন খুব জোরে হচ্ছে।

“দেখুন, আমির… সারা…” ডাক্তারের গলাটা খুব পেশাদার, ভাবলেশহীন। তিনি প্রথমে সারার ফাইলটা হাতে নিলেন। “সারা, আপনার রিপোর্টগুলো আমি দেখলাম। হরমোনাল প্রোফাইল, আল্ট্রাসাউন্ড, ওভুলেশন স্টাডি—সবই একদম পারফেক্ট। আপনার জরায়ু (Uterus) এবং ডিম্বাশয় (Ovaries) খুব ভালো অবস্থায় আছে। ইউ আর কমপ্লিটলি হেলদি। মা হওয়ার জন্য আপনার শরীরে কোনো বাধা নেই।”

সারার মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। সে আমিরের দিকে তাকাল। আমিরও হাসল। সে জানত, তার সারা একদম পারফেক্ট। তার ওই মাখন নরম শরীর, ওই ভরাট বুক, আর ওই রসালো গুদ—সব কিছুই তো সৃষ্টি করা হয়েছে মা হওয়ার জন্য।

“কিন্তু…” ডাক্তার রাও শব্দটি উচ্চারণ করতেই ঘরের বাতাসটা যেন ভারী হয়ে গেল। তিনি এবার আমিরের ফাইলটা খুললেন। তার ভুরুটা একটু কুঁচকে গেল। তিনি একবার আমিরের দিকে তাকালেন, তারপর রিপোর্টের দিকে।

“আমির… প্রবলেমটা আপনার রিপোর্টে,” ডাক্তার সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন। “আমরা আপনার সিমেন অ্যানালিসিস (Semen Analysis) করেছি। রিপোর্টটা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ইনফ্যাক্ট, এটা বেশ সিরিয়াস।”

আমিরের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। “সিরিয়াস? মানে? স্পার্ম কাউন্ট কি একটু কম?” সে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল।

ডাক্তার মাথা নাড়লেন। “কম নয় আমির। আপনার স্পার্ম কাউন্ট… ক্লিনিক্যালি জিরো। আপনার বীর্যে কোনো শুক্রাণু বা স্পার্ম পাওয়া যায়নি। মেডিক্যালের ভাষায় এটাকে আমরা ‘অ্যাজোস্পার্মিয়া’ (Azoospermia) বলি।”

এক মুহূর্তের জন্য আমিরের মনে হলো সময় থমকে গেছে। “জিরো”। শব্দটা তার কানে বোমার মতো ফাটল। জিরো? শূন্য? তার মানে সে ফাঁকা গুলি ছুড়ছিল এতদিন? তার মানে তার ওই শক্ত বাঁড়া, ওই ঘন মাল, ওই উত্তাল সেক্স—সবই কি তবে মিথ্যা? সবই কি ভুয়া?

“জিরো মানে… একদমই নেই?” আমিরের গলা দিয়ে স্বর বেরোল না।

“না,” ডাক্তার নির্মম সত্যটা জানালেন। “আপনার টেস্টিস বা অণ্ডকোষে স্পার্ম তৈরি হচ্ছে না, অথবা তৈরি হলেও সেটা বেরোচ্ছে না। আমরা আরও কিছু টেস্ট করতে পারি কারণটা জানার জন্য, কিন্তু বর্তমান রিপোর্ট অনুযায়ী… আপনি ন্যাচারাল বা স্বাভাবিক উপায়ে বাবা হতে পারবেন না। ইউ আর ইনফার্টাইল।”

আমির পাথরের মতো বসে রইল। তার মনে হলো তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। ইনফার্টাইল। বন্ধ্যা। নপুংসক। শব্দগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সে আড়চোখে সারার দিকে তাকাল। সারাও স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার ফর্সা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

কিন্তু আমিরের মনের ভেতরে তখন শুরু হয়ে গেছে এক অন্য ঝড়। ডাক্তার যখন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন, আমিরের মন তখন পাড়ি দিয়েছিল অতীতে। সেই পুরনো বাড়ি, সেই বন্ধ দরজার ভাঙা কাঁচের ফুটো, আর সেই অন্ধকার বারান্দা।

তার মনে পড়ে গেল সেই রাতগুলোর কথা। যখন সে তার বাবার আদিম খেলার সাক্ষী হতো, আর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের বাঁড়াটা হাতে নিয়ে ঘষত। সে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তার বীর্য, তার যৌবনের নির্যাস ওই নোংরা মেঝেতে বা টিস্যু পেপারে নষ্ট করেছে। সে তখন ভাবত, সে আনন্দ পাচ্ছে। কিন্তু এখন? এখন তার মনে হলো, ওটা আনন্দ ছিল না, ওটা ছিল আত্মহনন।

‘এটা কি তারই শাস্তি?’ আমিরের বিবেকের দংশন শুরু হলো তীব্রভাবে। ‘আমি আমার নিজের মায়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়েছি। আমি আমার বাবার সঙ্গম দেখে মাস্টারবেট করেছি। আমি হারাম কাজ করেছি। মহাপাপ করেছি। আল্লাহ্ কি তাই আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? তিনি কি আমার বংশধরকে দুনিয়ায় আসতে দেবেন না বলে আমার কোমর ভেঙে দিয়েছেন? আমার বিচিতে কি তিনি বিষ ভরে দিয়েছেন?’

সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। তার মনে হলো, তার বাঁড়াটা এখন আর তার গর্বের বস্তু নয়, ওটা একটা অকেজো মাংসপিণ্ড মাত্র। সে পুরুষ নয়, সে অসম্পূর্ণ। সে সারাকে তৃপ্তি দিতে পারে, তার গুদ হয়তো মালে ভরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সে তাকে মা বানাতে পারবে না। সে তাকে ‘ফল’ দিতে পারবে না।

ডাক্তার আরও কিছু বলছিলেন—ডোনার স্পার্ম, আইভিএফ, সার্জারি—কিন্তু আমিরের কানে আর কিছু ঢুকছিল না। সে শুধু ভাবছিল, সে শেষ। তার সাজানো সংসার, তার রঙিন স্বপ্ন—সব কিছু এক নিমেষে চুরমার হয়ে গেল।

ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে তারা পার্কিং লটে এল। কেউ কোনো কথা বলল না। আমিরের মনে হলো, ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে বসে থাকা অন্য দম্পতিরা যেন তার দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসছে। যেন তারা জেনে গেছে, এই সুদর্শন যুবকটির পুরুষত্ব কেবল বাইরের খোলস মাত্র, ভেতরে সে ফাঁপা।

তারা গাড়িতে উঠল। আমির ড্রাইভিং সিটে বসল, কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দিল না। সে স্টিয়ারিং হুইলটা শক্ত করে ধরে পাথরের মতো বসে রইল। তার দৃষ্টি সামনের উইন্ডশিল্ডের বাইরে শূন্যে নিবদ্ধ। তার চোখ জ্বলছে, কিন্তু কান্না আসছে না। কান্না তো মেয়েদের জন্য, বা যাদের আশা আছে তাদের জন্য। কিন্তু যে পুরুষ জানে সে ‘নপুংসক’, তার কি কাঁদার অধিকার আছে?

পাশে সারা বসে আছে। সেও চুপ। আমির সাহস পাচ্ছিল না সারার দিকে তাকানোর। সে ভাবছিল, সারা এখন কী ভাবছে? সে নিশ্চয়ই ঘৃণা করছে আমিরকে? সে নিশ্চয়ই ভাবছে, কেন সে এই অকেজো লোকটাকে বিয়ে করতে গেল? তার তো আরও ভালো অপশন ছিল। সে সুন্দরী, শিক্ষিতা, তার তো কোনো দোষ নেই।

হঠাৎ, আমির একটা ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনল। সে চমকে পাশে তাকাল।

সারা কাঁদছে। নিঃশব্দে। তার চোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। সে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে তার চোখের জল আমিরকে দেখাতে চায় না। কিন্তু তার কাঁধটা কাঁপছে।

এই দৃশ্যটা আমিরকে ভেঙে চুরমার করে দিল। সারার এই কান্না কি তার জন্য? নাকি তার নিজের কপাল পোড়ার জন্য? আমির আর সহ্য করতে পারল না। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তবু সে কথা বলার চেষ্টা করল। তার মনে হলো, এখনই সব শেষ করে দেওয়া উচিত। সারার জীবনটা নষ্ট করার কোনো অধিকার তার নেই।

“সারা…” আমিরের গলাটা খসখসে, যেন বহু বছর পর কেউ কথা বলছে। “সারা… আমি… আমার জন্য…” সে কথা শেষ করতে পারল না। ঢোক গিলল। “তুমি… তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো। আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। তুমি মুক্ত। তুমি একটা বাচ্চা ডিজার্ভ করো… একটা পরিপূর্ণ সংসার ডিজার্ভ করো। আমি… আমি তোমাকে সেটা দিতে পারব না।”

আমিরের কথাগুলো গাড়ির বদ্ধ বাতাসে বিষের মতো ছড়াল। সে মাথা নিচু করে নিল, রায় শোনার অপেক্ষায়।

কিন্তু সারা যেটা করল, তার জন্য আমির প্রস্তুত ছিল না।

সারা এক ঝটকায় আমিরের দিকে ঘুরল। তার চোখ লাল, অশ্রুসিক্ত, কিন্তু সেই চোখের তারায় এখন জ্বলে উঠেছে এক প্রচণ্ড আগুনের শিখা। সে তার হাত দিয়ে আমিরের মুখটা তুলে ধরল।

“চুপ করো!” সারা প্রায় চিৎকার করে উঠল, তার গলার স্বরটা কান্নায় ভেজা হলেও তাতে ছিল ইস্পাতের মতো দৃঢ়তা। “একদম চুপ! তুমি ভাবলে কী করে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব? তুমি আমাকে কী মনে করো? আমি কি এখানে কোনো বিজনেস ডিল করতে এসেছি?”

আমির হতভম্ব হয়ে সারার দিকে তাকিয়ে রইল।

সারা তার দুই হাত দিয়ে আমিরের কলারটা খামচে ধরল, যেন সে তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বাস্তবে ফেরাতে চায়। “আমি কাঁদছি কারণ আমাদের স্বপ্নটা হোঁচট খেয়েছে। আমি কাঁদছি কারণ আমরা সহজে মা-বাবা হতে পারব না। তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য কাঁদছি না! আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমির! আই লাভ ইউ! তোমার রিপোর্ট যা-ই হোক, তুমি আমার আমির। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের কথা ভাবতেও পারি না!”

সারার এই কথাগুলো আমিরের বুকের ওপর থেকে যেন হাজার মণের পাথর নামিয়ে দিল। সে দেখল, এই মেয়েটি কেবল তাকে ভালোবাসে না, তাকে ধারণ করে।

সারা এবার আমিরকে জড়িয়ে ধরল। তার কান্নাটা এবার বাঁধ মানল না। সে আমিরের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমিরও তার হাত দুটো দিয়ে সারাকে বেষ্টন করে ধরল। সে তার চিবুকটা সারার মাথায় রাখল। তার নিজের চোখও ভিজে এল।

“আমি কোথাও যাচ্ছি না, আমির,” সারা ফুঁপাচ্ছে, কিন্তু তার কথাগুলো স্পষ্ট। “আমি তোমার সাথেই থাকব। কিন্তু… আমির… আমি একটা বাচ্চা চাই। আমি মা হতে চাই। আমাদের একটা বাচ্চা চাই। প্লিজ… তুমি কিছু একটা করো।”

সারার এই আকুতি—”আমাদের একটা বাচ্চা চাই”—আমিরের ভেতরে এক সুপ্ত জেদ জাগিয়ে তুলল। কিছুক্ষণ আগেও সে নিজেকে পরাজিত, নপুংসক ভাবছিল। কিন্তু সারার ভালোবাসা আর তার এই দাবি তাকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করল। সারা তাকে ছেড়ে যাবে না, কিন্তু সারা বাচ্চা চায়। এবং সে সেটা আমিরকে দিতে বলছে।

আমির সারাকে বুক থেকে একটু সরিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তার নিজের চোখের জল মুছে ফেলল। তার চোয়াল শক্ত হলো।

“আমরা পারব, সারা,” আমিরের গলায় এখন আর কোনো কম্পন নেই, আছে এক ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা। “আমরা একটা উপায় বের করবই। ডাক্তার বলেছে আমি ন্যাচারালি পারব না, কিন্তু অন্য উপায় তো আছে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, প্রমিস করছি, তুমি মা হবে। আর সেটা আমার রক্ত দিয়েই হবে।”

সারা আমিরের দিকে তাকিয়ে রইল, যেন সে আমিরের এই আত্মবিশ্বাসের মধ্যে ভরসা খুঁজছে।

আমির আবার বলল, “আর… এই ব্যাপারটা, এই রিপোর্টের কথা, শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে। আব্বু, তোমার বাবা-মা, কেউ জানবে না। এটা আমাদের সিক্রেট। আমরা আমাদের মতো করে সলিউশন বের করব।”

সারা মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, কেউ জানবে না।”

গাড়িটা যখন স্টার্ট নিল, তখন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। ওয়াইপারের ঘষঘষ শব্দে আমির ড্রাইভ করতে লাগল। তার মাথায় তখন ঘুরছে এক নতুন সমীকরণ। “আমার রক্ত… আমার বংশ…”। ডাক্তার বলেছে তার স্পার্ম নেই। কিন্তু তার রক্ত তো পৃথিবীতে আছে। তার একজন নিকটাত্মীয় আছে যার রক্ত, যার জিন, যার চেহারা—সব কিছুই আমিরের মতো। এমনকি তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী, বেশি সক্ষম।

ইমরান। তার বাবা।

আমিরের মনে পড়ে গেল সেই রাতের দৃশ্যগুলো। তার বাবার সেই অটুট পৌরুষ, সেই সক্ষমতা যা তার মাকে বছরের পর বছর সুখী করেছিল। তার বাবা তো আজও সক্ষম। তিনি তো আজও একজন ‘পুরুষ’।

বৃষ্টির ঝাপসা কাঁচের দিকে তাকিয়ে আমিরের মনে এক অদ্ভুত, বিকৃত কিন্তু যৌক্তিক চিন্তার জন্ম হলো। যদি তার নিজের স্পার্ম না থাকে, তবে তার বাবার স্পার্মই তো তার সবচেয়ে কাছের বিকল্প। সেটাই তো হবে ‘তাদের’ বাচ্চা, তাদের রক্ত। জেনেটিক্যালি তো সেটা আমিরেরই খুব কাছের হবে।

ব্যাঙ্গালোরের সন্ধ্যাটা আজ একটু অন্যরকম। আকাশে মেঘ জমেছে, বাতাস ভারী। আমিরের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে ফোনটা কানে চেপে ধরে আছে। ওপাশে রিং হচ্ছে। এই রিং হওয়ার সময়টুকুর প্রতিটি সেকেন্ড আমিরের কাছে ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছে। সে জানে, এই ফোনকলটা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো। “হ্যালো?” ইমরানের গলা। সেই একই রকম গম্ভীর, ভাবলেশহীন।

“আব্বু, আসসালামু আলাইকুম,” আমিরের গলাটা একটু কেঁপে গেল, যদিও সে চেষ্টা করল স্বাভাবিক রাখার।

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। বল, কেমন আছিস? সব ঠিকঠাক?”

আমির একটা গভীর শ্বাস নিল। সে আজ আর কোনো ভণিতা করবে না। সত্যটা বলতেই হবে, অন্তত আংশিক সত্য। “আব্বু, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। বিয়ের প্রস্তুতি… মানে ডেট আর ভেন্যু নিয়ে তো কথা হয়েছে। কিন্তু… একটা সমস্যা হয়েছে।”

ইমরানের গলার স্বর একটুও বদলাল না। “কী সমস্যা? ডেট নিয়ে কোনো ঝামেলা?”

“না, ডেট নয়,” আমির ঢোক গিলল। তার হাতের মুঠোটা রেলিংয়ের ওপর শক্ত হয়ে বসল। “আসলে… আমরা প্রি-ম্যারিটাল চেকআপ করিয়েছিলাম। ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছেন। সমস্যাটা… সমস্যাটা আমার, আব্বু।”

ওপাশে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। আমির শুধু নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছে। সে জানে তার বাবা এখন কী ভাবছেন। বংশরক্ষা, সমাজ, লজ্জা—সব কিছু হয়তো তার মাথায় ঘুরছে।

অবশেষে ইমরান কথা বললেন। “কী সমস্যা? খুলে বল।”

“আমি… আমার রিপোর্টে এসেছে…” আমিরের গলাটা খাদে নেমে গেল, “আমি বাবা হতে পারব না, আব্বু। ডাক্তার বলেছেন আমার স্পার্ম কাউন্ট জিরো। ন্যাচারালি কনসিভ করা ইম্পসিবল।”

ফোনের ওপাশে আবার সেই ভারী নীরবতা। ইমরান হয়তো একটা বড় ধাক্কা খেয়েছেন, কিন্তু তার প্রকাশভঙ্গি বরাবরের মতোই সংযত। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…। সবই আল্লাহ্‌র মর্জি। তিনি যাকে চান দেন, যাকে চান না দেন না। আমাদের তো সবর করা ছাড়া উপায় নেই।”

বাবার এই শান্ত প্রতিক্রিয়া আমিরকে একটু সাহস দিল। সে এবার তার তৈরি করা চিত্রনাট্যটা পেশ করল। “আব্বু, আমরা অনেক ভেবেছি। সারাও সব জানে। ও আমাকে সাপোর্ট করছে। আমরা ঠিক করেছি… আমরা আই.ভি.এফ (IVF)-এর মাধ্যমে চেষ্টা করব।”

“আই.ভি.এফ?” ইমরান জানতে চাইলেন, “সেটা কী?”

“টেস্ট টিউব বেবি, আব্বু। তবে যেহেতু আমার… মানে আমার স্যাম্পল কাজ করবে না, তাই আমাদের ডোনারের সাহায্য নিতে হবে। মানে স্পার্ম ব্যাংক থেকে… অন্য কারোর…” আমিরের মিথ্যা কথাটা বলতে গিয়ে একটু বাধল। সে বাবার প্রতিক্রিয়া মাপার চেষ্টা করল।

ইমরান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তিনি একজন বাস্তববাদী মানুষ। আবেগের চেয়ে সমাধান তার কাছে বেশি জরুরি। “অন্য কারোর? মানে অচেনা কারোর?”

“হ্যাঁ, আব্বু। এটাই একমাত্র রাস্তা,” আমির বলল।

ইমরান হয়তো মনে মনে হিসাব কষলেন। বংশ, রক্ত, আর বাস্তবতা। শেষমেশ তিনি তার রায় দিলেন, “ওকে। তোদের জীবন। তোরা শিক্ষিত ছেলেমেয়ে, যা ভালো বুঝিস কর। সংসার তোদের, সিদ্ধান্তও তোদেরই নিতে হবে। তবে… সমাজ বা আত্মীয়রা যেন কিছু না জানে। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যেই থাক।”

“অবশ্যই আব্বু, কেউ জানবে না,” আমির দ্রুত বলল।

ফোনটা রাখার পর আমির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রথম ধাপটা পার হওয়া গেছে। বাবা মেনে নিয়েছেন যে সমস্যাটা আছে এবং তার সমাধান দরকার। কিন্তু আমির জানত, আসল চ্যালেঞ্জটা এখনো বাকি। আসল নাটকটা অপেক্ষা করছে তার বেডরুমে।

রাত তখন এগারোটা। ডিনারের পর তারা বেডরুমে। এসি চলছে, কিন্তু ঘরের আবহাওয়াটা আজ গুমোট। সারা বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা ম্যাগাজিন উল্টাচ্ছে, কিন্তু তার মন সেখানে নেই। আমির ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল।

সে বিছানার পাশে বসল, সারার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিল। সারা ম্যাগাজিনটা পাশে রেখে আমিরের দিকে তাকাল। তার চোখে প্রশ্ন।

“আব্বুকে ফোন করেছিলাম,” আমির শুরু করল।

“কী বললেন উনি?” সারা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।

“সবটা বলেছি। মানে… আমার প্রবলেমটা। আর এটাও বলেছি যে আমরা আই.ভি.এফ-এর কথা ভাবছি,” আমির একটু থেমে যোগ করল, “আমি বাবাকে বলেছি আমরা ডোনার স্পার্ম নেব। মানে স্পার্ম ব্যাংক থেকে। এটাই আমাদের কভার স্টোরি থাকবে সবার কাছে, এমনকি বাবার কাছেও। তিনি মেনে নিয়েছেন।”

সারা আমিরের হাতটা একটু শক্ত করে ধরল। তার চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। “না, আমির।”

আমির অবাক হলো। “না মানে? তুমিই তো বলেছিলে বাচ্চা চাও। আই.ভি.এফ-ই তো একমাত্র রাস্তা। আর আমার তো…”

সারা উঠে বসল। সে আমিরের খুব কাছে সরে এল। তার নিঃশ্বাস আমিরের গালে লাগছে। “আই.ভি.এফ নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, আমির। আমি মা হতে চাই, তোমাকে বাবা বানাতে চাই। কিন্তু ‘ডোনার’… কোনো অচেনা লোকের… কোনো বিদেশীর বা অজানা কারোর স্পার্ম আমি আমার শরীরে নেব না।”

“তাহলে?” আমির বিভ্রান্ত। “তাহলে উপায় কী? আমার তো…”

সারা আমিরের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। তার গলার স্বরে এক অদ্ভুত আবেগ আর জেদ মিশে আছে। “শোনো আমির, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি এই বিয়েটা করছি তোমাকে, তোমার অস্তিত্বকে। যদি আমরা বাচ্চাই নিই, তবে সে যেন আমাদের হয়। তার মধ্যে যেন তোমার ছোঁয়া থাকে।”

“কিন্তু সারা, সেটা তো সম্ভব না…”

“সম্ভব,” সারা তাকে থামিয়ে দিল। “আমি চাই বাচ্চাটার জিন (genes) যেন তোমার মতো হয়। সে দেখতে যেন তোমার মতো হয়, তার গায়ের গন্ধ, তার স্বভাব যেন তোমার পরিবারের মতো হয়… যাতে আমি যখন তাকে পেটে ধরব, যখন তাকে কোলে নেব, আমি যেন অনুভব করতে পারি যে বাচ্চাটা তোমার… আমাদের। কোনো ল্যাবরেটরির অজানা স্যাম্পল নয়, যার কোনো পরিচয় নেই, যার সাথে তোমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই।”

আমির স্তব্ধ হয়ে গেল। সে সারার কথার গভীরতা মাপার চেষ্টা করল। সারা এমন একজন ডোনার চাইছে, যার ডিএনএ আমিরের সাথে মিলে যায়। যার রক্ত আর আমিরের রক্ত এক।

“আমার… আমার পরিবারের মতো জিন?” আমির বিড়বিড় করল। “তুমি… তুমি কি আত্মীয়দের কথা বলছ? কাজিন?”

সারা মাথা নাড়ল। “কাজিনরা দূরের। আমি চাই একদম তোমার কাছের কেউ। যার রক্তে তুমি আছ।”

আমির চুপ করে রইল। তার মস্তিষ্কের ভেতর একটা ঝড় শুরু হয়েছে। সারার এই অদ্ভুত, অথচ গভীর ভালোবাসার দাবি তাকে এক গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। সে শুধু বলল, “…আমি… আমি ভাবব এটা নিয়ে।”

সারা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মুখের ওপর একটা প্রশান্তির ছাপ। কিন্তু আমিরের চোখে ঘুম নেই। সে বিছানা ছেড়ে উঠে এল। স্লাইডিং ডোরটা সরিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল।

বাইরে ব্যাঙ্গালোরের রাত ঝকঝকে। ঠান্ডা বাতাস আমিরের গরম শরীরটাকে জুড়াতে পারছে না। সে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করল, কিন্তু ধরাল না। তার হাতে লাইটারটা বারবার জ্বলছে আর নিভছে।

‘আমার পরিবারের মতো জিন…’ সারার কথাটা তার কানে বাজছে। ‘আমার রক্ত… আমার মতো দেখতে…’

আমির মনে মনে তার ফ্যামিলি ট্রির ডালপালা খুঁজতে শুরু করল। তার কোনো ভাই নেই। সে একাই। তার চাচারা আছেন, কিন্তু তারা বয়স্ক এবং তাদের সাথে আমিরের চেহারা বা স্বভাবের কোনো মিল নেই। কাজিনরা? তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক থাকলেও তারা তো ‘আমির’ নয়।

‘আমার পরিবারে কে আছে? আমি? আমি তো ইনফারটাইল। আমি তো মৃত। আমার রক্ত এখানেই শেষ।’

হঠাৎ, অন্ধকারে বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা চিন্তা তার মাথায় খেলে গেল। একটা মুখ ভেসে উঠল তার চোখের সামনে।

তার রক্ত। তার ডিএনএ-র উৎস। যার চেহারা, যার গায়ের রং, যার উচ্চতা—সবই আমিরের মতো। বা বলা ভালো, আমিরের সব কিছুই যার থেকে পাওয়া।

ইমরান। তার বাবা।

আমিরের হাতটা কেঁপে উঠল। লাইটারটা হাত থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। ‘আব্বু…’

তার মনে পড়ে গেল সেই পুরনো বাড়ির কথা। সেই রাতের দৃশ্যগুলো। সেই ভাঙা কাঁচের ফুটো দিয়ে দেখা তার বাবার বলিষ্ঠ শরীর। সেই চওড়া পিঠ, সেই পেশিবহুল বাহু, আর সেই অদম্য পৌরুষ যা তার মাকে বছরের পর বছর সুখ দিয়েছে। তার বাবা তো আজও সক্ষম। তিনি তো আজও একজন ‘পুরুষ’। তার বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার শরীরের শক্তি তো কমেনি।

আমিরের মস্তিষ্কে এক বিকৃত কিন্তু অকাট্য যুক্তি তৈরি হতে শুরু করল। যদি তার নিজের স্পার্ম না থাকে, তবে তার বাবার স্পার্মই তো তার সবচেয়ে কাছের বিকল্প। জেনেটিক্যালি, তার বাবার সন্তান আর তার নিজের সন্তানের মধ্যে পার্থক্যটা কতটুকু? তারা তো একই রক্তের ধারক। বাবার স্পার্ম মানেই তো আমিরের জিনের মূল উৎস।

‘সারা চেয়েছে আমার মতো কাউকে… আমার পরিবারের রক্ত। আব্বুর চেয়ে কাছে আর কে হতে পারে?’

কিন্তু পরমুহূর্তেই একটা ভয়াবহ চিন্তা তাকে গ্রাস করল। তার বাবা… আর সারা? তার স্ত্রী? তার বাবার সাথে তার স্ত্রীর মিলন?

না, আই.ভি.এফ-এ তো মিলন হয় না। ওটা তো ল্যাবে হয়। কিন্তু… ডাক্তার তো বলেছিল আই.ভি.এফ ব্যয়সাপেক্ষ এবং সবসময় সফল হয় না। আর তাছাড়া, তার বাবাকে কি সে বলতে পারবে—”আব্বু, আপনার স্পার্ম দিন, ল্যাবে গিয়ে দিয়ে আসুন?” ইমরান কি সেটা মানবেন? তিনি তো এসব আধুনিকতা বোঝেন না, মানবেনও না।

তাহলে?

আমিরের মনে পড়ল সেই দৃশ্যগুলো। তার মা, সুরাইয়া, কীভাবে তার বাবার নিচে পিষে যেতেন। কীভাবে তার বাবা পশুর মতো তার মাকে ভোগ করতেন। সেই দৃশ্যগুলো একসময় তাকে উত্তেজিত করত, তাকে আসক্ত করেছিল। আজ সেই স্মৃতিগুলোই তাকে এক অদ্ভুত সমাধানের পথ দেখাচ্ছে।

যদি ন্যাচারাল ওয়েতে হয়?

চিন্তাটা এতই জঘন্য, এতই নিষিদ্ধ যে আমিরের গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু একই সাথে তার তলপেটে এক তীব্র, পরিচিত মোচড় দিল। সেই পুরনো আসক্তি, সেই পুরনো উত্তেজনা যা সে ভেবেছিল মরে গেছে, তা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

সে ভাবল, ‘সারা বাচ্চা চায়। সে আমার রক্ত চায়। আব্বু বংশধর চান। আর আমি… আমি কী চাই?’

‘আমার পরিবারে আর একজনই পুরুষ আছে… আব্বু।’

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সে শেষবারের মতো তার সিগারেটটা ছাইদানিতে পিষে দিল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। তার মস্তিষ্কে এখন আর কোনো নীতি-নৈতিকতা বা ধর্মের বালাই নেই, আছে কেবল এক অন্ধ জেদ—সারাকে তার প্রাপ্য দিতে হবে, আর তার বংশরক্ষা করতে হবে।

সারা ড্রয়িংরুমে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা কাজ করছিল। আমির ধীর পায়ে ভেতরে এল। তার মুখমণ্ডল শক্ত, চোয়াল বদ্ধ।

“সারা,” আমির ডাকল।

সারা মুখ তুলে তাকাল। “বলো?”

“আমাকে একবার কলকাতা যেতে হবে। কালকেই।”

সারা অবাক হলো। “হঠাৎ? কোনো ইমার্জেন্সি? আব্বু ঠিক আছেন তো?”

আমির মাথা নাড়ল। “আব্বু ঠিক আছেন। আসলে… নিকাহ্-এর কিছু কেনাকাটা বাকি আছে। আর… আব্বুকে ওই আই.ভি.এফ-এর ব্যাপারটা, মানে ডোনারের বিষয়টা সামনাসামনি বোঝাতে হবে। ফোনে এসব কথা হয় না। তিনি পুরনো দিনের মানুষ, তাকে রাজি করানোটা জরুরি।”

সারা ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে এল। সে আমিরের বুকের ওপর হাত রাখল। “তুমি ঠিক বলেছ। ফ্যামিলি ডোনারের বিষয়টা আব্বুকে বোঝানো কঠিন হবে। তুমি যাও। ওনাকে বুঝিয়ে বলো যে এটা আমাদের জন্য কতটা ইম্পরট্যান্ট।”

আমির সারার কপালে চুমু খেল। মনে মনে বলল, ‘তুমি জানো না সারা, আমি কী করতে যাচ্ছি। আমি জাহান্নামের দরজা খুলতে যাচ্ছি, শুধু তোমার জন্য।’

কলকাতা। সেই পুরনো পাড়া, সেই পুরনো গলি। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় আমিরের বুকটা ধক করে উঠল। এই বাড়িটা, এই দেওয়ালগুলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় গোপন সাক্ষী। আজ সে আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু এবার দর্শক হিসেবে নয়, এক অদ্ভুত প্রস্তাব নিয়ে।

কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুললেন ইমরান। পরনে লুঙ্গি আর ফতুয়া, চোখে সেই চিরচেনা চশমা। বয়সের ছাপ পড়েছে চুলে আর দাড়ি-গোঁফে, কিন্তু শরীরের গঠন এখনো মজবুত। তিনি ছেলেকে দেখে হাসলেন না, শুধু দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিলেন। “আয়।”

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই সেই পরিচিত লোবানের গন্ধ আর স্যাঁতসেঁতে ভাবটা আমিরকে ঘিরে ধরল। ড্রয়িংরুমে পুরনো সোফাটা এখনো একই জায়গায়। করিডরের শেষ মাথায় সেই বন্ধ দরজাটা—তার মায়ের ঘর। আমির সেদিকে তাকাল না।

রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে। কলকাতার বর্ষা সব সময় একটু বেশিই মেলানকলিক। বসার ঘরে শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। ইমরান সোফায় বসে পানের বাটা থেকে পান সাজছেন। আমির উল্টোদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে। ঘরের আবহাওয়ায় এক ধরণের থমথমে ভাব।

আমির গলাটা পরিষ্কার করে নিল। “আব্বু…”

ইমরান পানে চুন লাগাতে লাগাতে বললেন, “বল। হঠাৎ চলে এলি, নিশ্চয়ই বড় কোনো ব্যাপার।”

“জ্বি আব্বু,” আমির সামনে ঝুঁকলো, হাত দুটো কোলের ওপর শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ। “বিয়ের কথা তো চলছে… কিন্তু ওই আই.ভি.এফ (IVF)-এর ব্যাপারে যে বলেছিলাম… ওতে একটা সমস্যা আছে।”

ইমরান পানের খিলিটা মুখে পুরলেন। চিবোতে চিবোতে বললেন, “কীসের সমস্যা? টাকা-পয়সার? আমি তো বলেছি টাকার দরকার হলে…”

“না আব্বু, টাকা নয়,” আমির তাকে থামিয়ে দিল। সে তার বাবার চোখের দিকে তাকানোর সাহস সঞ্চয় করল। “সারা… সারা চায় না যে আমরা বাইরের কোনো ডোনার নিই। ও স্পার্ম ব্যাংকের অজানা, অচেনা কারো জিন নিতে চায় না।”

ইমরান ভুরু কুঁচকে তাকালেন। “তাহলে? বাচ্চা হবে কী করে?”

আমির একটা বড় ঢোক গিলল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। “সারা চায়… বাচ্চাটার মধ্যে যেন আপনার রক্ত থাকে। আমাদের পরিবারের রক্ত থাকে। ও চায় বাচ্চার চেহারা, স্বভাব, সব যেন আমাদের বংশের মতো হয়।”

ইমরান খাওয়া থামিয়ে দিলেন। ঘরের নিস্তব্ধতা আরও ভারী হয়ে উঠল। “পরিবারের রক্ত? মানে?”

আমির কাঁপছে। কিন্তু সে জানে এখন আর পিছু হঠা যাবে না। “আমাদের পরিবারে… মানে আমার রক্ত আর আপনার রক্ত তো এক। আমার যেহেতু সমস্যা আছে… তাই আমাদের পরিবারে আপনি ছাড়া আর কে আছে আব্বু?”

ইমরান প্রথমে কথাটার অর্থ বুঝতে পারলেন না। তিনি ফ্যালফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে তার চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময়, অবিশ্বাস আর সবশেষে এক প্রচণ্ড ধাক্কার ছাপ ফুটে উঠল।

“কী বলছিস তুই?” ইমরানের গলার স্বরটা খাদে নেমে গেল। “তোর মাথা ঠিক আছে? পরিবারের… মানে? তুই আমাকে…”

আমির মাথা নিচু করে ফেলল। তার কান গরম হয়ে গেছে। “আব্বু… আমি… আমি আপনাকে… সাহায্য করতে বলছি। সারা চায়… বাচ্চাটা আপনার হোক। মানে… জিনগতভাবে।”

ইমরান যেন বৈদ্যুতিক শক খেলেন। তিনি ঝটকা দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার হাতের পানের বাটাটা ঠনঠন শব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। তার ফর্সা মুখটা রাগে আর ঘৃণায় লাল হয়ে উঠল।

“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ…” ইমরান বিড়বিড় করে উঠলেন, যেন কোনো শয়তানকে তাড়ানোর চেষ্টা করছেন। “আল্লাহ্ ছাড়া কোনো শক্তি নেই… তুই! তুই তোর নিজের বাবাকে এই কথা বলছিস? তুই আমাকে এই গুনাহ্-র কথা বলতে পারলি, আমির?”

ইমরান ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে পায়চারি করতে লাগলেন। তার শ্বাস দ্রুত পড়ছে। “সে তোর হবু স্ত্রী! সে আমার বউমা (daughter-in-law)! তুই চাইছিস আমি… ছিঃ! ছিঃ! এর চেয়ে আমার মরণ হলো না কেন?”

আমির চুপ করে বসে রইল। সে জানত এই ঝড়টা আসবে। সে প্রস্তুত ছিল।

আমির উঠে গিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসল। সে ছোটবেলার মতো বাবার পা জড়িয়ে ধরল না, কিন্তু তার গলায় ছিল এক গভীর আর্তনাদ।

“আব্বু, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি কোনো পাপ করতে বলছি না। এটা ডাক্তারি ব্যাপার। ল্যাবরেটরিতে হবে। আপনার শুধু স্যাম্পলটা লাগবে। আব্বু, আমি ইনফার্টাইল। আমি মরা। আমার বংশ এখানেই শেষ হয়ে যাবে। আপনি কি চান না আপনার বংশের কেউ থাকুক? আপনার নাতি বা নাতনি হোক, যার শরীরে আপনার রক্ত বইবে?”

ইমরান থামলেন। ‘বংশ’ শব্দটা তার দুর্বল জায়গা। তিনি একজন রক্ষণশীল, পারিবারিক মানুষ। তার কাছে নিজের নাম, নিজের রক্তধারা বজায় রাখাটা একটা পবিত্র দায়িত্বের মতো।

“কিন্তু তাই বলে বউমা…” ইমরান তোতালেন।

“সারা-ই এটা চেয়েছে আব্বু,” আমির মিথ্যে বলল না, আবার পুরো সত্যও বলল না। “ও আপনাকে শ্রদ্ধা করে। ও চায় না কোনো বাজে লোকের রক্ত তার পেটে আসুক। ও চায় খানদান। আর আপনি তো জানেন, ডাক্তার বলেছে আমার দ্বারা হবে না। আপনি সাহায্য না করলে… সারা হয়তো আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমাদের সংসারটা ভেঙে যাবে আব্বু।”

আমির তার তুরুপের তাসটা চালল। সংসার ভাঙার ভয় আর বংশরক্ষার লোভ।

ইমরান সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন। তিনি কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। বাইরের বৃষ্টির শব্দ এখন আরও জোরে শোনা যাচ্ছে। ঘরের ভেতরে পিতা ও পুত্রের মাঝখানে এক অলীক, নিষিদ্ধ প্রস্তাব ঝুলে রইল।

“আমাকে ভাবতে দে,” ইমরান ক্লান্ত গলায় বললেন। “তুই এখন যা। আমার চোখের সামনে থেকে যা।”

আমির নিজের ঘরে চলে এল। সেই পুরনো ঘর। সেই বন্ধ দরজা। সে বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হলো সে তার বাবার মনের ভেতরে একটা বিষাক্ত বীজ পুঁতে দিয়ে এসেছে। এখন শুধু অপেক্ষা, সেই বীজটা মহীরুহ হয়ে ওঠার।

সারা রাত ইমরান তার ঘরে একা বসে রইলেন। তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ পড়লেন কি না আমির জানে না। কিন্তু সে শুনতে পেল বাবার ঘর থেকে পায়চারির শব্দ। ইমরান একজন বাস্তববাদী লোক। তিনি আবেগের চেয়ে হিসাব বেশি বোঝেন। তিনি ভাবছেন—তার ছেলের অক্ষমতা, তার বংশের ভবিষ্যৎ, আর এক যুবতী নারীর মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা।

তার চোখের সামনে ভেসে উঠল সারার ছবি। ছবিটা তিনি দেখেননি, শুধু আমিরের বর্ণনায় শুনেছেন। কিন্তু এখন তার কল্পনায় এক নারীমূর্তি ভাসছে, যে তার বংশধরকে ধারণ করবে। কিন্তু ল্যাবরেটরি? টেস্ট টিউব? ইমরান মাথা নাড়লেন। ওসব প্লাস্টিকের ডাক্তারি তার পছন্দ নয়। ওটা তার কাছে পুরুষত্বের অপমান মনে হয়। তিনি যদি তার বীজ দেন, তবে সেটা তার পৌরুষের মাধ্যমেই দেবেন।

পরের দিন সকাল। বৃষ্টির রেশ কেটে গেছে, কিন্তু আকাশ মেঘলা। নাস্তার টেবিলে আবার সেই থমথমে ভাব। আমির ভয়ে ভয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল।

ইমরান ঘরে ঢুকলেন। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি। তিনি আজ খুব শান্ত, খুব ধীরস্থির। তিনি চেয়ার টেনে বসলেন।

আমির বাবার মুখের দিকে তাকাল। সেখানে কোনো রাগ নেই, আছে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা।

“আমি ভেবে দেখেছি,” ইমরান শান্ত কিন্তু ইস্পাতের মতো দৃঢ় গলায় বললেন।

আমিরের হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এল। “কী… কী ভেবেছেন আব্বু?”

ইমরান ছেলের চোখের দিকে সরাসরি তাকালেন। “তুই ঠিকই বলেছিস। বংশরক্ষা করা দরকার। আর তুই যখন অক্ষম, তখন পরিবারের বড় হিসেবে দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। আমি তোকে সাহায্য করতে রাজি আছি।”

আমিরের চোখেমুখে এক ঝলক আশার আলো খেলে গেল। “সত্যি আব্বু? আপনি স্পার্ম দিতে রাজি?”

ইমরান হাত তুললেন। “দাঁড়া। আমার কথা শেষ হয়নি। আমি রাজি, কিন্তু…”

“কিন্তু কী, আব্বু?”

ইমরান টেবিলের ওপর রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে লাগলেন। তিনি সময় নিচ্ছেন। “ওই ক্লিনিক, ডাক্তার, টেস্ট টিউব… ওসব আমার দ্বারা হবে না। আমি কোনো মেশিনে বা বোতলে আমার জিনিস ভরতে পারব না। ওটা… ওটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। ওটা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ।”

আমির বিভ্রান্ত। “তাহলে? আপনি ল্যাবে যাবেন না?”

“না,” ইমরান মাথা নাড়লেন। তার গলায় এখন এক অদ্ভুত গাম্ভীর্য, যা আমিরকে ভয় পাইয়ে দিল। “আমি যদি আমার রক্ত দিই, আমি যদি তোদের ‘পরিবার’-কে সাহায্য করি, তবে সেটা প্রাকৃতিক উপায়ে (natural process) হবে।”

আমিরের শরীরটা হিম হয়ে গেল। “প্রাকৃতিক উপায় মানে?” সে বিড়বিড় করল, যদিও তার মস্তিষ্কের গভীরে সে মানেটা জানত।

ইমরান সোজা হয়ে বসলেন। তার দৃষ্টিতে এখন সেই পুরনো, আদিম পুরুষের ছায়া, যা আমির ছোটবেলায় দরজার ফুটো দিয়ে দেখেছিল।

“মানেটা তুই বুঝিস, আমির। ন্যাকা সাজিস না,” ইমরান নিষ্ঠুরভাবে স্পষ্ট করে দিলেন। “আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক বিশেষ পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধির জন্য। আমি যদি বাবা হতে চাই, আমি সেই পদ্ধতিতেই হব। কোনো ডাক্তার বা ইঞ্জেকশন দিয়ে নয়। আমি বউমার সাথে মিশব, যেমন স্বামী-স্ত্রীর মিলন হয়। একমাত্র সেভাবেই আমি তাকে বাচ্চা দেব।”

আমিরের মনে হলো তার চারপাশের বাতাসটা বিষাক্ত হয়ে গেছে। সে তার বাবাকে এই প্রস্তাবটা দেওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু তার বাবা যে নিজেই সেই শর্তটা দেবেন, তা সে কল্পনাও করেনি। সে ভেবেছিল স্পার্ম ডোনেশন, কিন্তু তার বাবা চাইছেন সঙ্গম।

“কিন্তু আব্বু… সারা… ও তো…”

“এটাই আমার শর্ত,” ইমরান টেবিলের ওপর হাত রাখলেন। “আমার বীর্য যদি তার শরীরে ঢুকতে হয়, তবে সেটা আমার মাধ্যমেই ঢুকবে। কোনো সিরিঞ্জ দিয়ে নয়। আমি কোনো ডোনার মেশিন নই, আমি একজন পুরুষ।”

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। “এবং, আমার শেষ কথা—আমি রাজি আছি, কিন্তু জোর করে নয়। বউমা যদি রাজি থাকে, তবেই এটা হবে। তুই তাকে সব খুলে বলবি। সে যদি এই ‘ন্যাচারাল প্রসেস’-এ রাজি হয়, তবেই আমি ব্যাঙ্গালোর যাব। আর যদি না হয়, তবে ওই আই.ভি.এফ বা অন্য যা খুশি তোরা কর, আমি নেই।”

ইমরান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমির চেয়ারে বসে রইল, যেন তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে, কিন্তু তার মূল্যটা যে এত ভয়ানক হবে, তা সে বুঝতে পারেনি। ‘প্রাকৃতিক উপায়’। তার বাবা তার স্ত্রীর সাথে শোবে। তার সম্মতিতে, তার অনুরোধে।

কেমন লাগলো গল্পটি?

রেট দিতে ৫ স্টার নির্বাচন করুন!

সার্বিক ফলাফল 5 / ৫ । মোট ভোট 1

এখনো কেউ ভোট দেয়নি! প্রথম ভোটটি দিন !

যদি গল্পটি ভালো লেগে থাকে…

আমাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে অনুসরণ করুন!

দুঃখিত, গল্পটি আপনার ভালো লাগেনি!

আমাদের আরও উন্নত করতে সাহায্য করুন

দয়া করে লিখুন কীভাবে আমরা গল্পটি আরও ভালো করতে পারি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top