
শয়তানের চুক্তি – অঙ্ক ১
শয়তানের চুক্তি অঙ্ক ১: চুক্তি এবং দেবর কলকাতার আলিপুরের এক বহুতলের পেন্টহাউস। ফ্লোর-টু-সিলিং কাঁচের জানালার বাইরে শহরের আকাশটা যেন একটা তারায় ভরা কালো চাদর। নিচে টিমটিম করে জ্বলছে অগণিত গাড়ির হেডলাইট, যেন এক চলমান নক্ষত্রপুঞ্জ। কিন্তু এই বিলাসবহুল, আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরের বাতাসটা ছিল ভারী, শীতল এবং বারুদে ঠাসা। যে কোনও মুহূর্তে একটা ছোট স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট ছিল সবকিছু জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি, রায়ান, সেই স্ফুলিঙ্গটাকে মরিয়া হয়ে আটকানোর চেষ্টা করছিলাম। আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। আমি একজন সফল ব্যবসায়ী। আমার নামে কোম্পানি আছে, গাড়ি আছে, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। বাইরে থেকে দেখলে, আমার জীবনে কোনও কিছুর অভাব নেই। কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ, আমার স্ত্রী জারিন, আমার হাত থেকে বালির মতো খসে পড়ছিল। জারিন আমার থেকে ছ’বছরের ছোট। উনত্রিশ বছরের এক জীবন্ত ভাস্কর্য। ফর্সা রঙ, টানা টানা কাজল কালো চোখ, আর শরীরটা যেন কোনও নিপুণ শিল্পী পরম যত্নে তৈরি করেছে। সে যখন হাঁটে, তখন মনে হয় যেন কোনও রাজহাঁস জলের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক অতৃপ্ত, অস্থির আত্মা। যে আত্মাটা আমার ভালোবাসা, আমার টাকা, আমার এই বিলাসবহুল খাঁচার মধ্যে ছটফট করছিল। সেদিন রাতেও সেই ছটফটানিটা চরমে উঠেছিল। আমরা ডিনার শেষ করে লিভিং রুমে বসেছিলাম। দামী ক্রিস্টালের গ্লাসে সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি। কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যেই ছিল এক হিমশীতল নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভাঙল জারিন। তার গলাটা ছিল শান্ত, কিন্তু সেই শান্ত স্বরের গভীরে ছিল এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের শীতলতা। “আমি আর পারছি না, রায়ান।” আমি তার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল না। তার দৃষ্টি ছিল জানালার বাইরের সেই অন্তহীন অন্ধকারের দিকে। “কী পারছ না, জারিন?” আমার গলাটা কেঁপে গেল। আমি জানতাম, সে কী বলতে চলেছে। কিন্তু আমি শুনতে চাইছিলাম না। “এই অভিনয়,” সে বলল। “এই সুখী দম্পতির অভিনয়। এই ভালোবাসা, এই সংসার—সবকিছু আমার কাছে এখন একটা বোঝা বলে মনে হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।” “দম বন্ধ হয়ে আসছে?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। “আমি তোমাকে কী দিইনি, জারিন? এই ফ্ল্যাট, এই গাড়ি, দামী গয়না, ফরেন ট্রিপ—তুমি যা চেয়েছ, আমি তাই দিয়েছি। তোমার আর কী চাই?” সে এবার আমার দিকে ফিরল। তার সুন্দর চোখ দুটোয় আমার জন্য কোনও ভালোবাসা ছিল না। ছিল শুধু একরাশ করুণা আর তাচ্ছিল্য। “তুমি সত্যিই বোঝো না, রায়ান? নাকি বুঝতে চাও না?” সে হাসল। একটা তিক্ত, বিষণ্ণ হাসি। “আমি শরীর নিয়ে কী করব, যদি আমার আত্মাটাই মরে যায়? আমি এই দামী গয়নাগুলো পরে কাকে দেখাব, যদি আমার মনের ভেতরটা ফাঁকা থাকে? তুমি আমাকে সবকিছু দিয়েছ, রায়ান। শুধু একটা জিনিস ছাড়া।” “কী?” আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। “উত্তেজনা,” সে বলল। “প্যাশন। অ্যাডভেঞ্চার। তুমি একজন ভালো মানুষ, রায়ান। একজন ভালো স্বামী। কিন্তু তুমি বড্ড বেশি ভালো। বড্ড বেশি নরম। বড্ড বেশি অনুমানযোগ্য। তোমার সাথে আমার জীবনটা একটা শান্ত, স্থির দিঘির মতো। যেখানে কোনও ঢেউ নেই, কোনও স্রোত নেই। আমি এই শান্ত জলে ডুবে মরতে চাই না। আমি সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে চাই। আমি ঝড় চাই, রায়ান।” তার কথাগুলো আমার বুকে ছুরির মতো বিঁধছিল। নরম। আমি নরম। এই অভিযোগটা আমি আগেও শুনেছি। আমার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলে, আমি নাকি বড্ড বেশি নীতি মেনে চলি। কিন্তু আমার নিজের স্ত্রী, আমার ভালোবাসার নারী, সেও আমাকে এই কথাই বলবে? “তাহলে তুমি কী চাও, জারিন?” আমার গলাটা শুকিয়ে আসছিল। “তুমি কি… তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাও?” প্রশ্নটা করার সাথে সাথেই আমার মনে হলো, আমার পায়ের নিচের মাটিটা সরে যাচ্ছে। জারিনকে ছাড়া আমার জীবন! আমি কল্পনাও করতে পারি না। সে আমার অক্সিজেন। সে আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। জারিন কোনও উত্তর দিল না। সে শুধু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার সেই নীরবতাই ছিল আমার প্রশ্নের উত্তর। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। আমি তাকে হারাতে পারব না। কিছুতেই না। তাকে ধরে রাখার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। সবকিছু। আর তখনই, আমার মনের গভীরে, আমার পৌরুষের ধ্বংসস্তূপের ওপর, একটা ভয়ংকর, নোংরা ఆలోచన জন্ম নিল। একটা শয়তানের চুক্তি। “না,” আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম। “তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না, জারিন। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।” আমি তার পায়ের কাছে, মেঝেতে বসে পড়লাম। তার হাত দুটো আমার হাতে তুলে নিলাম। “প্লিজ, জারিন। আমাকে ছেড়ে যেও না।” সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে তখনও সেই করুণা। “আমি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই,” আমি বললাম। আমার নিজের গলাটা আমার কাছে অচেনা লাগছিল। “একটা চুক্তি।” সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। “আমি জানি, আমি তোমাকে সেই উত্তেজনাটা দিতে পারি না, যা তুমি চাও,” আমি বললাম। আমার প্রত্যেকটা শব্দ ছিল আমার পুরুষত্বকে বলি দেওয়ার এক একটা ধাপ। “আমি জানি, আমার শরীর তোমাকে তৃপ্ত করতে পারে না। কিন্তু আমি তোমাকে হারাতেও পারব না।” আমি একটা লম্বা শ্বাস নিলাম। তারপর আমার জীবনের সবচেয়ে অপমানজনক কথাটা উচ্চারণ করলাম। “তুমি… তুমি বাইরে নিজের সুখ খুঁজে নিতে পারো, জারিন।” জারিন চমকে উঠল। তার সুন্দর চোখ দুটো অবিশ্বাসে বড় বড় হয়ে গেল। “আমি তোমাকে কোনও প্রশ্ন করব না। আমি কোনও বাধা দেব না,” আমি একটানা বলে চললাম। “তুমি যার সাথে খুশি মিশতে পারো, যেখানে খুশি যেতে পারো। তুমি তোমার জীবনের সব উত্তেজনা, সব অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করতে পারো। আমার শুধু একটাই শর্ত।” “কী শর্ত?” তার গলাটা ফিসফিসে শোনাচ্ছিল। “তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না,” আমি তার হাতে চুমু খেয়ে বললাম। “তুমি এই বাড়িতেই থাকবে। আমার স্ত্রী হিসেবে। সমাজের চোখে আমরা এক সুখী দম্পতি হয়েই থাকব। শুধু বন্ধ দরজার আড়ালে, তুমি তোমার জীবনটা নিজের মতো করে বাঁচবে। আর আমি? আমি শুধু তোমাকে আমার পাশে পেলেই খুশি।” আমার কথাগুলো শেষ হওয়ার পর, ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘ, ভারী নীরবতা নেমে এল। জারিন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুখের অভিব্যক্তি পড়া যাচ্ছিল না। সে কি অবাক হয়েছে? নাকি ঘৃণা করছে আমাকে? অবশেষে, সে হাসল। প্রথমে একটা মৃদু হাসি। তারপর সেই হাসিটা আরও চওড়া হলো। তার চোখেমুখে আমি বিস্ময়, তাচ্ছিল্য আর তার সাথে এক নতুন ক্ষমতার দম্ভ দেখতে পেলাম। সে হয়তো ভাবতেও পারেনি, আমি তাকে ধরে রাখার জন্য এতটা নিচে নামতে পারি। সে আমার প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করল না। সে শুধু আমার হাত থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। “আমার ঘুম পাচ্ছে,” সে শান্ত গলায় বলল। “আমি শুতে গেলাম।” সে আমার দিকে আর ফিরেও তাকাল না। নিজের বেডরুমের দিকে চলে গেল। আমি মেঝেতে বসে রইলাম। একজন পরাজিত, অপমানিত, কিন্তু এক অদ্ভুত স্বস্তি পাওয়া পুরুষ। আমি জানি, আমি আমার সম্মান, আমার পুরুষত্ব—সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি। কিন্তু আমি জারিনকে হারাইনি। আমাদের শয়তানের চুক্তিটা সেই রাতেই স্বাক্ষরিত হয়ে গিয়েছিল। কোনও কাগজ বা কলম দিয়ে নয়। আমার অসহায়ত্ব আর জারিনের নীরব সম্মতি দিয়ে। অঙ্ক ১ (চলবে): পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং