জাহান্নামের পথ – অঙ্ক ১
জাহান্নামের পথ অঙ্ক ১: আপাত সুখ কলকাতার অভিজাত এলাকা বালিগঞ্জ প্লেসের একটা শান্ত, সবুজ গলি। দুপাশে বড় বড় গাছগুলো যেন রাস্তার ওপর একটা প্রাকৃতিক ছাদ তৈরি করে দিয়েছে। সেই গলির ভেতরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়ি, ‘চৌধুরী ভিলা’। সাদা রঙের দোতলা বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় এর বাসিন্দাদের রুচি এবং আভিজাত্য। চারপাশে সুন্দর বাগান, তাতে মরসুমি ফুলের বাহার। একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, নিরাপদ আশ্রয়। অন্তত আমার তাই মনে হতো। আমার নাম আমির। বয়স একুশ। ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারের ছাত্র। দু’বছর আগে আমার মা, আমিনা বেগম, দীর্ঘ অসুস্থতার পর মারা যান। মায়ের মৃত্যু আমার পৃথিবীটাকে এক মুহূর্তে ওলটপালট করে দিয়েছিল। বাবা, ইরফান চৌধুরী, শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। আমিও। আমাদের সাজানো, সুখী পরিবারটা যেন একটা শূন্যতার ব্ল্যাক হোলে হারিয়ে যাচ্ছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করতে এসেছিলেন লায়লা। লায়লা আন্টি। বাবার দূর সম্পর্কের বন্ধুর বিধবা স্ত্রী। সাথে তার ফুটফুটে মেয়ে, সারা। বাবা যখন লায়লা আন্টিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, আমি প্রথমে মেনে নিতে পারিনি। আমার মায়ের জায়গা অন্য কেউ নেবে, এটা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। কিন্তু লায়লা আন্টি তার ভালোবাসা, তার স্নেহ, তার যত্ন দিয়ে আমার সব প্রতিরোধ ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি কখনও আমার মা হওয়ার চেষ্টা করেননি, তিনি হয়েছিলেন আমার বন্ধু, আমার অভিভাবক। ধীরে ধীরে, আমি তাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি। তিনি আমার জীবনে হয়ে ওঠেন লায়লা মা। আজ, দু’বছর পর, চৌধুরী ভিলা আবার একটা সুখী গৃহকোণ। আমরা চারজন—বাবা, লায়লা মা, তার মেয়ে সারা, আর আমি। বাইরে থেকে দেখলে আমাদের পরিবারটা একটা আদর্শ। একজন সফল ব্যবসায়ী, তার সুন্দরী, রুচিশীল স্ত্রী, আর তাদের দুই পড়ুয়া, বুদ্ধিমান ছেলেমেয়ে। একটা নিখুঁত ছবি। কিন্তু সব নিখুঁত ছবির পেছনেই নাকি একটা গল্প থাকে। আমাদেরটাও ছিল। শুধু সেই গল্পের শেষটা যে এমন ভয়ংকর, তা আমি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। সেদিন ছিল শুক্রবার। নভেম্বরের এক আরামদায়ক বিকেল। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ আমার ঘরের জানালার কাঁচ গলে আমার পড়ার টেবিলে এসে পড়েছে। আমি এরিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর একটা জটিল অধ্যায়ে ডুবেছিলাম। শব্দগুলো আমার চোখের সামনে ভাসছিল, কিন্তু মাথায় ঢুকছিল না। আমার মনটা বারবার চলে যাচ্ছিল ডাইনিং টেবিলের দিকে। লায়লা মা আজ আমার পছন্দের মাটন কোর্মা রান্না করছেন। তার রান্নার হাত অসাধারণ। সারা বাড়ি সেই কোর্মার মনমাতানো গন্ধে ভরে আছে। আমার ঘরটা দোতলার কোণায়। বেশ বড় আর খোলামেলা। একপাশে বইয়ের তাক, তাতে থরে থরে সাজানো আমার পাঠ্যবই আর গল্পের বই। অন্যপাশে আমার সিঙ্গল বেড, পরিপাটি করে গোছানো। দেয়ালের রঙ হালকা নীল। আমার মায়ের পছন্দের রঙ। এই ঘরটা আমার দুর্গ, আমার ব্যক্তিগত জগৎ। দরজায় হালকা টোকা পড়ল। “আমির, ভেতরে আসব?” লায়লা মায়ের গলা। তার গলার স্বরে এমন একটা স্নেহ মেশানো থাকে, যা শুনলে মন ভালো হয়ে যায়। “এসো মা,” আমি বই থেকে মুখ তুলে বললাম। দরজা খুলে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। তার পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের সুতির শাড়ি। মুখে কোনও মেকআপ নেই, শুধু কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। চল্লিশ বছর বয়সেও তাকে কী অপূর্ব সুন্দরী লাগে! তার চেহারায় একটা অদ্ভুত শান্তি, একটা স্নিগ্ধতা আছে। তিনি হাতে করে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে এসেছেন। “অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিস। একটু ব্রেক নে,” তিনি কফির কাপটা আমার টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন। “ধন্যবাদ মা। এটারই দরকার ছিল।” তিনি আমার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসলেন। আমার খোলা বইটার দিকে তাকালেন। “কী পড়ছিস এত মন দিয়ে?” “পলিটিক্যাল ফিলোসফি। খুব বোরিং,” আমি হাসলাম। তিনিও হাসলেন। তার হাসিতে মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “পড়াশোনা তো করতেই হবে, বাবা। তোর বাবা তোর ওপর অনেক আশা করে আছে। তুই আমাদের পরিবারের গর্ব।” তার কথাগুলো আমার বুকে একটা উষ্ণ স্রোতের মতো বয়ে গেল। মায়ের মৃত্যুর পর এই মানুষটাই আমাকে আগলে রেখেছে। আমার পড়াশোনা, আমার খাওয়া-দাওয়া, আমার মন খারাপ—সবকিছুর খেয়াল রাখেন তিনি। আমি জানি, তিনি আমার গর্ভধারিণী মা নন, কিন্তু তার ভালোবাসায় কোনও খাদ নেই। “তোমার জন্যই তো এতদূর আসতে পেরেছি, মা,” আমি sinceramente বললাম। “তুমি যদি না থাকতে…” “চুপ কর,” তিনি আমার মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন। “আমি তোর মা। মায়ের কর্তব্য করেছি, এর মধ্যে ‘যদি’, ‘কিন্তু’ কিছু নেই।” তিনি আমার পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে দিলেন। “তোর পাঞ্জাবির বোতামটা ভাঙা। দে, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।” তিনি আমার খুব কাছে সরে এলেন। তার শরীর থেকে একটা হালকা জেসমিন ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। খুব চেনা, খুব নিরাপদ একটা গন্ধ। তিনি নিচু হয়ে আমার বুকের কাছে ঝুঁকে পড়লেন। তার শাড়ির আঁচলটা আমার হাতের ওপর এসে পড়ল। আমি তার ঘাড়ের কাছে অনাবৃত মসৃণ ত্বকটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনে কোনও নোংরা চিন্তা এল না। শুধু একটা গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা অনুভব করলাম। এই নারী আমার মা। আমার সম্মান। “হয়ে গেছে,” তিনি বোতামটা লাগিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। “কফিটা খেয়ে নে, ঠান্ডা হয়ে যাবে।” তিনি উঠে দাঁড়ালেন। “আমি নিচে যাচ্ছি। সারাটা আবার রান্নাঘরে ঢুকে কী সব এক্সপেরিমেন্ট করছে কে জানে। পুরো রান্নাঘরটার দফারফা না করে ছাড়বে না।” তার কথায় আমি হেসে ফেললাম। সারা, আমার সৎ-বোন। বয়সে আমার থেকে দু’বছরের ছোট। কলেজে পড়ে। সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে। তার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। সারাক্ষণ খুনসুটি, ঝগড়া, আবার একে অপরের জন্য গভীর টান। লায়লা মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আবার আমার দিকে ফিরলেন। “তাড়াতাড়ি নিচে আসিস। আজ তোর বাবাও তাড়াতাড়ি ফিরবে বলেছে। একসাথে ডিনার করব।” “আচ্ছা মা,” আমি মাথা নাড়লাম। তিনি চলে যাওয়ার পরেও ঘরের মধ্যে তার শরীরের সেই মিষ্টি জেসমিন গন্ধটা কিছুক্ষণ রয়ে গেল। আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম। পারফেক্ট। ঠিক যেমন আমি খাই। কম চিনি, স্ট্রং। এই ছোট ছোট জিনিসগুলোও তিনি কত খেয়াল রাখেন! আমার মনটা এক গভীর কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবলাম, আল্লাহ যা করেছেন, ভালোর জন্যই করেছেন। তিনি আমার কাছ থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছেন, কিন্তু তার বদলে আর একজন মা-কে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার জীবনটা আবার স্থিতিশীল, আবার সুখী। সন্ধ্যার পর আমি নিচে নামলাম। ড্রয়িং রুম থেকে সারা আর লায়লা মায়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। আমি রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলাম। যা ভেবেছিলাম, তাই। সারা একটা অ্যাপ্রন পরে স্যালাড বানানোর চেষ্টা করছে, আর অর্ধেক জিনিসপত্র নিচে ফেলে একাকার কাণ্ড করেছে। “এটা কী হচ্ছে এখানে? বিশ্বযুদ্ধ?” আমি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম। সারা আমার দিকে ঘুরে তাকাল। তার মুখে শসার টুকরো লেগে আছে। “খবরদার, আমির ভাইয়া! আমার ক্রিয়েটিভিটিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবি না। আজ আমি এমন একটা স্যালাড বানাব, যা খেয়ে বাবা অজ্ঞান হয়ে যাবে।” “সে তো দেখতেই পাচ্ছি,” আমি হাসলাম। “স্যালাড খেয়ে অজ্ঞান হবে, নাকি তোর এই কিম্ভূত চেহারা দেখে, সেটাই ভাবছি।” “যাহ্! তুমি খুব পচা,” সারা মুখ ভেংচে বলল। লায়লা মা আমাদের খুনসুটি দেখে হাসছিলেন। “তোরা থামবি? আমির, তুই ওকে একটু সাহায্য কর। আমি বরং ফিরনিটা দেখে আসি।”