আদিবাসী প্রথায় মা আর ছেলের বিয়ে: Part 1

উনচল্লিশ বছর বয়সে, মায়া চৌধুরী ছিলেন এক জীবন্ত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি শুধু একজন সুন্দরী, অভিজাত মহিলাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন কলকাতা কর্পোরেট জগতের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। তার নিজের হাতে গড়া টেক্সটাইল এম্পায়ার, “মায়ালিকা”, ছিল তার বুদ্ধি, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং তার নির্দয় নিয়ন্ত্রণের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তার পঞ্চাশ তলার অফিসের কোণার কেবিন থেকে, তিনি শুধু তার ব্যবসাই চালাতেন না, চালাতেন তার চারপাশের মানুষগুলোর জীবনও। তার প্রতিটি ইশারা, প্রতিটি চাহনি ছিল এক একটা অলঙ্ঘনীয় আদেশ।

তার পঞ্চাশ বছর বয়সী স্বামী, বিক্রম, ছিলেন এই বিশাল সাম্রাজ্যের একজন সুন্দর, সজ্জিত অংশীদার। বাইরে থেকে দেখলে, তারা ছিল এক পারফেক্ট পাওয়ার কাপল। কিন্তু ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই, এই নিখুঁত ছবির পেছনের সত্যটা বেরিয়ে পড়ত। তাদের সম্পর্কটা ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে তৈরি ছিল না, ছিল ক্ষমতা, বোঝাপড়া আর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে। বিক্রম মায়ার ক্ষমতাকে সম্মান করত, হয়তো কিছুটা ভয়ও পেত। আর মায়া? সে বিক্রমকে তার জীবনের একজন প্রয়োজনীয় অংশীদার হিসেবে দেখত, কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে কোনো উষ্ণতা ছিল না।

আর তাদের উনিশ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে, রোহান? সে ছিল এই ক্ষমতা আর দূরত্বের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শিকার। সে তার মায়ের ছায়ায়, তার মায়ের পরিচয়ে বড় হয়েছে। সে তার মাকে ভালোবাসত, তাকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করত ভয়। মায়া রোহানকে ভালোবাসত, কিন্তু তার ভালোবাসাটাও ছিল নিয়ন্ত্রিত। সে চাইত, রোহান তার মতো হবে—শক্তিশালী, সফল, নির্দয়। কিন্তু রোহান ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে ছিল শান্ত, সংবেদনশীল এবং কিছুটা অন্তর্মুখী। সে তার মায়ের বিশাল ব্যক্তিত্বের নিচে সবসময় নিজেকে ছোট এবং অসহায় অনুভব করত।

এই নিখুঁত কিন্তু শীতল জীবনের গতিপথটা এক মুহূর্তে, এক ঝটকায় পাল্টে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।

সেদিন ছিল এক মেঘলা, ঠান্ডা সকাল। মায়ালিকার একটা নতুন ফ্যাক্টরির উদ্বোধন ছিল অরুণাচল প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মায়ার জন্য এটা ছিল এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। তাকে সেদিন সকালেই সেখানে পৌঁছাতে হতো।

“রোহান, তুমি তৈরি তো?” মায়া তার পার্সটা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল। তার গলায় ছিল তার স্বাভাবিক কর্তৃত্বের সুর।

“হ্যাঁ, মা,” রোহান তার জ্যাকেটটা পরতে পরতে উত্তর দিল। সে এই সফরে যেতে চায়নি। তার বন্ধুদের সাথে তার অন্য পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তার মায়ের আদেশ অমান্য করার সাহস তার ছিল না।

“বিক্রম, তুমি আসছো না?” মায়া তার স্বামীর দিকে তাকাল, যে তখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল।

বিক্রম কাগজের ওপর থেকে চোখ না তুলেই উত্তর দিল, “না, ডার্লিং। আমার শেষ মুহূর্তে একটা জরুরি বোর্ড মিটিং পড়ে গেছে। তোমরা এগিয়ে যাও। আমি কালকের ফ্লাইটে চলে আসব।”

মায়ার মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটে উঠল না। সে জানত, বিক্রম আসবে না। সে তার নিজের জগতে ব্যস্ত।

মায়া আর রোহান তাদের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে গেল, যা তাদের পেন্টহাউসের ছাদের হেলিপ্যাডেই অপেক্ষা করছিল। এটা ছিল তাদের জীবনের স্বাভাবিক অঙ্গ—বিলাসিতা, গতি এবং বিচ্ছিন্নতা।

হেলিকপ্টারটা যখন কলকাতার আকাশ ছেড়ে, সবুজ মাঠ, নদী পেরিয়ে, ধীরে ধীরে পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে এগোতে শুরু করল, তখন ভেতরের পরিবেশটা ছিল শান্ত, কিন্তু শীতল। মায়া তার ল্যাপটপে ঝুঁকে পড়ে শেষ মুহূর্তের ফাইলপত্র দেখছিল, আর রোহান জানলার কাঁচ দিয়ে বাইরের মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না।

কিন্তু যত তারা অরুণাচলের গভীরে প্রবেশ করছিল, তত আবহাওয়াটা খারাপ হতে শুরু করল। মেঘগুলো আরও ঘন, আরও কালো হয়ে আসছিল। বাতাসটা ছিল অশান্ত। হেলিকপ্টারটা সামান্য দুলতে শুরু করল।

পাইলট, একজন অভিজ্ঞ প্রাক্তন এয়ার ফোর্স অফিসার, কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, “ম্যাডাম, আবহাওয়াটা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমরা হয়তো আর এগোতে পারব না।”

“হোয়াট ননসেন্স!” মায়ার গলাটা ছিল বরফের মতো ঠান্ডা। “আমার এই মিটিংটা অ্যাটেন্ড করাটা কতটা জরুরি, তুমি জানো? তোমাকে এর জন্যই এত টাকা দেওয়া হয়। কপ্টার ওড়াও।”

পাইলট আর কোনো কথা বলল না। সে তার অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে গিয়ে, তার মালকিনের আদেশ পালন করার চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু প্রকৃতি কোনো মালকিনের আদেশ শোনে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই, তারা এক ভয়ংকর তুষার ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেল। চারপাশটা ছিল সাদা, ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বাতাসটা তখন দানবের মতো গর্জন করছে, আর তাদের ছোট হেলিকপ্টারটাকে একটা খেলনার মতো করে দোলাচ্ছে। ককপিটের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল বিভিন্ন ধরনের সতর্কতামূলক বিপ বিপ শব্দ।

“ম্যাডাম, আমরা কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি! মেডে! মেডে!” পাইলটের গলার স্বরটা ছিল আতঙ্কে ভরা।

রোহান ভয়ে তার সিটটা আঁকড়ে ধরেছিল। সে তার মায়ের দিকে তাকাল। সে দেখল, তার সেই আত্মবিশ্বাসী, নিয়ন্ত্রক মায়ের মুখেও প্রথমবার ফুটে উঠেছে এক তীব্র, আদিম ভয়।

তারপর, একটা কান ফাটানো, যান্ত্রিক আর্তনাদের সাথে, হেলিকপ্টারের একটা পাখা ভেঙে গেল। কপ্টারটা এক ভয়ংকর ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে, নিচের বরফঢাকা, জনমানবহীন, সাদা অনন্তের দিকে আছড়ে পড়তে শুরু করল।

শেষ মুহূর্তে, রোহান শুধু দেখেছিল তার মায়ের বিস্ফারিত, আতঙ্কিত চোখ দুটো।

কতক্ষণ পর তার জ্ঞান ফিরেছিল, রোহান জানে না।

যখন সে চোখ খুলল, তখন তার মাথার ভেতরটা হাজারটা হাতুড়ির আঘাতে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তার সারা শরীর ছিল ব্যথায় ভরা। সে দেখল, সে হেলিকপ্টারের ভাঙা কেবিনের ভেতরে, একটা সিটের সাথে বেল্ট দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঝুলে আছে। তার চারপাশে ছিল ভাঙা কাঁচ, ছেঁড়া তার, আর পোড়া প্লাস্টিকের তীব্র গন্ধ।

আর ছিল এক গভীর, হাড় কাঁপানো, অশুভ নীরবতা।

সে কোনোমতে নিজেকে মুক্ত করে, টলতে টলতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল।

বাইরের দৃশ্যটা ছিল একই সাথে অবিশ্বাস্য রকমের সুন্দর এবং ভয়ংকর। যতদূর চোখ যায়, শুধু বরফ। সাদা, নরম বরফের চাদর, যা পুরো পৃথিবীটাকে ঢেকে দিয়েছে। মাথার ওপর আকাশটা ছিল ধূসর। আর তাদের চারপাশে ছিল বিশাল, বরফঢাকা, নাম না জানা পাহাড়ের সারি। বাতাসটা ছিল তীক্ষ্ণ, ঠান্ডা, যা তার ফুসফুসের ভেতরটাকেও জমিয়ে দিচ্ছিল।

তারা এক জনমানবহীন, ঈশ্বরের পরিত্যক্ত জায়গায় এসে পড়েছে।

রোহান দেখল, ককপিটটা সম্পূর্ণভাবে থেঁতলে গেছে। পাইলট তার সিটের ওপর মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, তার মাথাটা সামনের কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর ঝুলে আছে।

এই ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখেও, রোহান কান্নায় ভেঙে পড়ল না। তার ভেতরের সমস্ত ভয়কে ছাপিয়ে, একটা অন্য অনুভূতি জেগে উঠছিল। দায়িত্ববোধ।

“মা!” সে চিৎকার করে উঠল।

সে তার মাকে খুঁজতে শুরু করল। সে দেখল, মায়া কপ্টারের ভাঙা দরজা থেকে প্রায় বিশ ফুট দূরে, বরফের ওপর অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তার কপালটা কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে তার ফর্সা মুখটাকে লাল করে দিয়েছে। তার দামী ডিজাইনার পোশাকটা ছিঁড়ে গেছে।

রোহান দৌড়ে তার মায়ের কাছে গেল। সে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। সে তার কাঁপা কাঁপা হাতটা তার মায়ের নাকের কাছে নিয়ে গেল।

হ্যাঁ, খুব দুর্বল, কিন্তু নিঃশ্বাস চলছে।

রোহান তার জীবনের প্রথম, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিল। সে আর তার মায়ের ছায়ায় থাকা সেই ভীতু, নির্ভরশীল ছেলেটা ছিল না। এই মুহূর্তে, এই বরফের নরকে, সে-ই ছিল একমাত্র রক্ষক।

মায়ার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে দেখল, সে একটা ছোট, পাথরের গুহার মতো জায়গায় শুয়ে আছে। তার শরীরে জড়ানো আছে হেলিকপ্টারের সিট থেকে খোলা একটা মোটা কম্বল। আর তার পাশে, একটা ছোট আগুন জ্বলছে। আগুনের হলদে আলোয় গুহার ভেতরটা ছিল উষ্ণ এবং নিরাপদ।

আর আগুনের পাশে, রোহান বসেছিল। তার মুখটা ছিল ক্লান্ত, চিন্তিত, কিন্তু তার চোখে ছিল এক নতুন, দৃঢ় সংকল্প।

“রোহান?” মায়ার গলাটা ছিল দুর্বল, ভাঙা।

রোহান চমকে তার দিকে তাকাল। “মা! তোমার জ্ঞান ফিরেছে!” সে দৌড়ে তার কাছে এল।

“আমরা… আমরা কোথায়?”

“আমরা বেঁচে আছি, মা,” রোহান তার মায়ের হাতটা ধরল। “এটাই এখন সবচেয়ে বড় সত্যি।”

মায়ার আত্মবিশ্বাসী, নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিত্বটা এই চরম পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়েছিল। সে তার চারপাশের অসহায় অবস্থাটা দেখল, নিজের আহত শরীরটাকে অনুভব করল। তার চোখ দুটো জলে ভরে এল। এই প্রথমবার, তার জীবনের এই প্রথমবার, সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে অসহায়, সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল অনুভব করছিল।

আর যার ওপর সে নির্ভরশীল ছিল, সে হলো তার নিজের ছেলে।

এরপরের কয়েকটা দিন ছিল এক ভয়ংকর, сюররিয়াল দুঃস্বপ্নের মতো। তাদের পরিচিত জগৎ, তাদের ক্ষমতা, তাদের পরিচয়—সবকিছুই সেই বরফঢাকা, জনমানবহীন পার্বত্য অঞ্চলে হারিয়ে গিয়েছিল। এখন তাদের只有一个ই পরিচয় ছিল—দুজন অসহায় মানুষ, যারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

আর এই লড়াইয়ে, তাদের দুজনের ভূমিকাটা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গিয়েছিল।

মায়া চৌধুরী, যে নারী তার নিজের বিশাল অফিসের বোর্ডরুমে বসে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করত, সে এখন ছিল এক ভাঙা, অসহায় নারী। তার পায়ের গোড়ালিতে মারাত্মক চোট লেগেছিল, তার শরীর ছিল দুর্বল এবং জ্বরে আক্রান্ত। তার দামী পোশাকগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল, তার আত্মবিশ্বাসী, নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিত্বটা চুরমার হয়ে গিয়েছিল। সে বেশিরভাগ সময়ই গুহার ভেতরে, কম্বলের নিচে শুয়ে কাঁপত—ঠান্ডায় এবং ভয়ে। সে প্রথমবারের মতো তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল।

আর রোহান, যে ছেলেটা এতদিন তার মায়ের বিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়ায় বড় হয়েছে, যার প্রতিটি সিদ্ধান্ত তার মা ঠিক করে দিত, সে-ই এখন এই ভয়ংকর পরিস্থিতির চালক হয়ে উঠেছিল। এই চরম সংকট তার ভেতরের ঘুমিয়ে থাকা পুরুষটাকে, তার ভেতরের শক্তি এবং সাহসকে জাগিয়ে তুলেছিল।

সে তার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রথম বর্ষের বইতে পড়া বেঁচে থাকার কৌশলগুলো মনে করার চেষ্টা করছিল। সে হেলিকপ্টারের ভাঙা অংশ থেকে ধাতব পাত খুলে এনে গুহার মুখটা আড়াল করার ব্যবস্থা করেছিল, যাতে বরফ হাওয়া সরাসরি ভেতরে ঢুকতে না পারে। সে আগুনটাকে কোনোদিনও নিভতে দেয়নি। সে বরফ গলিয়ে খাওয়ার জলের ব্যবস্থা করেছিল। সে তার আহত মায়ের যত্ন নিচ্ছিল এক অবিশ্বাস্য ধৈর্য এবং মমতার সাথে।

প্রতিদিন সকালে, সে তার নিজের ছিঁড়ে যাওয়া শার্টের একটা অংশ দিয়ে, গরম জলে ভিজিয়ে, তার মায়ের কপালের ক্ষতটা পরিষ্কার করে দিত। তার শক্ত, কিছুটা খসখসে আঙুলগুলো যখন তার মায়ের নরম, মসৃণ ত্বকের ওপর পড়ত, তখন মায়ার পুরো শরীরটা এক অদ্ভুত, অব্যক্ত আবেগে কেঁপে উঠত। এই স্পর্শগুলো ছিল প্রয়োজনের, কিন্তু তার মধ্যে ছিল এক গভীর মমতা, এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, যা সে তার স্বামী বিক্রমের কাছ থেকে কোনোদিনও পায়নি।

রাতের বেলা, যখন বরফ পড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যেত, তখন গুহার ভেতরের ছোট আগুনটাও তাদের উষ্ণ রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল না। প্রথম রাতে, মায়া ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল।

রোহান আর কোনো উপায় না দেখে, তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং অন্তরঙ্গ সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল। সে তার মায়ের পাশে, কম্বলের নিচে ঢুকে, তাকে নিজের শরীর দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। সে তার নিজের শরীরের সমস্ত উষ্ণতা দিয়ে তার মাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।

এই স্পর্শগুলো কোনো কামনার ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার। কিন্তু এই forced intimacy, এই চূড়ান্ত নির্ভরতা, তাদের সম্পর্কের সমীকরণটাকে চিরকালের জন্য বদলে দিচ্ছিল। মায়া তার ছেলের শক্তিশালী বুকের ওপর মাথা রেখে, তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ শুনত। সে অনুভব করত তার ছেলের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা, তার বাহুবন্ধনের নিরাপত্তা। এই প্রথমবার, সে তার ছেলেকে একজন পুরুষ এবং রক্ষক হিসেবে দেখছিল। আর রোহান? সে তার মাকে, তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদকে, তার বুকে জড়িয়ে ধরে রাখত। তার মায়ের শরীরের নরম, নারীসুলভ অনুভূতি, তার চুলের গন্ধ—সবকিছুই তার উনিশ বছর বয়সী তরুণ শরীরে এক গভীর, প্রায় আধ্যাত্মিক ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলছিল।

নতুন জগৎ এবং এক ভয়ংকর প্রস্তাব

প্রায় তিন দিন ধরে এই অসম লড়াই চলার পর, যখন তাদের আনা সামান্য খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের বেঁচে থাকার আশাও প্রায় নিভে আসছিল, তখন তারা এল।

রোহান সেদিন গুহার বাইরে গিয়েছিল যদি কোনো শিকার বা খাওয়ার যোগ্য কিছু পাওয়া যায়, সেই আশায়। সে যখন হতাশ হয়ে ফিরে আসছিল, তখন সে দেখল, বরফের ওপর দিয়ে কয়েকটা লম্বা, ছায়ামূর্তি তাদের গুহার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের পরনে ছিল পশুর চামড়ার পোশাক, আর হাতে ছিল ধারালো বল্লম আর তীর-ধনুক।

রোহানের বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে পালাল না। সে দৌড়ে গুহায় ফিরে এসে, তার মাকে আড়াল করে, গুহার মুখে একটা ভাঙা ধাতব রড হাতে নিয়ে দাঁড়াল।

সেই শিকারী দলটি ছিল এক স্থানীয় আদিবাসী উপজাতির। তারা এই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের একমাত্র বাসিন্দা। তারা নিঃশব্দে গুহার সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের মুখ ছিল ভাবলেশহীন, চোখ দুটো ছিল বরফের মতোই ঠান্ডা এবং penetrative।

তারা রোহানের হাতের অস্ত্র বা তার প্রতিরোধের ভঙ্গিতে কোনো ভ্রূক্ষেপ করল না। তাদের মধ্যে যে দলপতি, সে শুধু গুহার ভেতরে শুয়ে থাকা মায়ার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকাল। তারপর সে তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে, তাদের নিজস্ব ভাষায় কিছু একটা বলল।

পরের কয়েকটা ঘণ্টা ছিল এক ঘোরের মতো। সেই আদিবাসী দলটি তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করল না। তারা ইশারায় বোঝাল যে তারা তাদের সাহায্য করতে চায়। তারা মায়ার জন্য একটা কাপড় দিয়ে অস্থায়ী স্ট্রেচার তৈরি করল। তারপর, তারা মা আর ছেলেকে নিয়ে, তাদের নিজেদের গ্রামের দিকে যাত্রা করল।

উপজাতির গ্রামটি ছিল সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। পাহাড়ের এক সুরক্ষিত উপত্যকায়, কয়েকটা কাঠের আর পাথরের বাড়ি নিয়ে তৈরি সেই গ্রামটা ছিল যেন সময় থেকে বিচ্ছিন্ন এক অন্য জগৎ। তাদের নিজস্ব নিয়ম, নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং নিজস্ব প্রথা ছিল।

মায়া এবং রোহান বুঝতে পারছিল, তাদের পুরনো পরিচয়, তাদের টাকা, তাদের ক্ষমতা—এই জগতে সম্পূর্ণ অর্থহীন। তারা এখন এই আদিম, রহস্যময় উপজাতির আশ্রিত। তাদের জীবন এখন এই উপজাতির দয়ার ওপর নির্ভরশীল।

উপজাতির मुखिया, অর্থাৎ গ্রাম প্রধান, ছিলেন একজন অত্যন্ত বৃদ্ধ, কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল আশ্চর্যরকমের তীক্ষ্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন না, কিন্তু তিনি তাদের পরিস্থিতি বুঝতেন। তিনি মায়া এবং রোহানের জন্য একটি আলাদা, উষ্ণ ঘরের ব্যবস্থা করে দিলেন। তাদের খাবার এবং চিকিৎসারও ব্যবস্থা করলেন।

কয়েকদিন ধরে, তিনি শুধু মায়া এবং রোহানকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি দেখলেন, কীভাবে ছেলেটা তার অসুস্থ মায়ের যত্ন নিচ্ছে। তিনি দেখলেন, কীভাবে মহিলাটি তার ছেলের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।

অবশেষে, প্রায় এক সপ্তাহ পর, তিনি উপজাতির অন্যান্য বয়স্কদের সাথে আলোচনা করে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন।

তিনি তার দোভাষীকে (যে সামান্য হিন্দি এবং ইংরেজি বলতে পারত) সাথে নিয়ে, মায়া এবং রোহানের ঘরে এলেন।

“তোমরা এখন অনেকটা সুস্থ,” मुखिया দোভাষীর মাধ্যমে বললেন। “তোমাদের দেখে আমরা খুশি।”

“আপনাদের অনেক ধন্যবাদ,” মায়া দুর্বলভাবে উত্তর দিল। “আপনারা না থাকলে আমরা হয়তো বেঁচেই থাকতাম না।”

প্রধান মাথা নাড়লেন। “কিন্তু তোমরা সারাজীবন আমাদের অতিথি হয়ে থাকতে পারো না।”

“আমরা জানি,” মায়া বলল। “আবহাওয়াটা একটু ভালো হলেই, আমরা এখান থেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করব।”

“না,” প্রধান-র গলাটা ছিল চূড়ান্ত। “তোমরা এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে না। এই বরফের রাজ্যে, একজন একা মহিলা এবং একজন একা পুরুষের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তোমরা আবার বিপদে পড়বে।”

তিনি এক মুহূর্ত থামলেন। তারপর তার চূড়ান্ত রায়টা শোনালেন।

“উপজাতি তোমাদের আশ্রয় দেবে, তোমাদের নিজেদের একজন করে নেবে। কিন্তু একটি শর্তে।”

তিনি মায়া এবং রোহানের চোখের দিকে সরাসরি তাকালেন। “আমাদের নিয়ম অনুযায়ী, আমাদের প্রথা অনুযায়ী, তোমাদের দুজনকে বিয়ে করতে হবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top