জাহান্নামের পথ – অঙ্ক ১

This entry is part 1 of 6 in the series জাহান্নামের পথ

জাহান্নামের পথ

অঙ্ক ১: আপাত সুখ

কলকাতার অভিজাত এলাকা বালিগঞ্জ প্লেসের একটা শান্ত, সবুজ গলি। দুপাশে বড় বড় গাছগুলো যেন রাস্তার ওপর একটা প্রাকৃতিক ছাদ তৈরি করে দিয়েছে। সেই গলির ভেতরেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাড়ি, ‘চৌধুরী ভিলা’। সাদা রঙের দোতলা বাড়িটা দেখলেই বোঝা যায় এর বাসিন্দাদের রুচি এবং আভিজাত্য। চারপাশে সুন্দর বাগান, তাতে মরসুমি ফুলের বাহার। একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, নিরাপদ আশ্রয়। অন্তত আমার তাই মনে হতো।

আমার নাম আমির। বয়স একুশ। ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারের ছাত্র। দু’বছর আগে আমার মা, আমিনা বেগম, দীর্ঘ অসুস্থতার পর মারা যান। মায়ের মৃত্যু আমার পৃথিবীটাকে এক মুহূর্তে ওলটপালট করে দিয়েছিল। বাবা, ইরফান চৌধুরী, শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। আমিও। আমাদের সাজানো, সুখী পরিবারটা যেন একটা শূন্যতার ব্ল্যাক হোলে হারিয়ে যাচ্ছিল।

সেই শূন্যতা পূরণ করতে এসেছিলেন লায়লা। লায়লা আন্টি। বাবার দূর সম্পর্কের বন্ধুর বিধবা স্ত্রী। সাথে তার ফুটফুটে মেয়ে, সারা। বাবা যখন লায়লা আন্টিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, আমি প্রথমে মেনে নিতে পারিনি। আমার মায়ের জায়গা অন্য কেউ নেবে, এটা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। কিন্তু লায়লা আন্টি তার ভালোবাসা, তার স্নেহ, তার যত্ন দিয়ে আমার সব প্রতিরোধ ভেঙে দিয়েছিলেন। তিনি কখনও আমার মা হওয়ার চেষ্টা করেননি, তিনি হয়েছিলেন আমার বন্ধু, আমার অভিভাবক। ধীরে ধীরে, আমি তাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি। তিনি আমার জীবনে হয়ে ওঠেন লায়লা মা।

আজ, দু’বছর পর, চৌধুরী ভিলা আবার একটা সুখী গৃহকোণ। আমরা চারজন—বাবা, লায়লা মা, তার মেয়ে সারা, আর আমি। বাইরে থেকে দেখলে আমাদের পরিবারটা একটা আদর্শ। একজন সফল ব্যবসায়ী, তার সুন্দরী, রুচিশীল স্ত্রী, আর তাদের দুই পড়ুয়া, বুদ্ধিমান ছেলেমেয়ে। একটা নিখুঁত ছবি। কিন্তু সব নিখুঁত ছবির পেছনেই নাকি একটা গল্প থাকে। আমাদেরটাও ছিল। শুধু সেই গল্পের শেষটা যে এমন ভয়ংকর, তা আমি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।

সেদিন ছিল শুক্রবার। নভেম্বরের এক আরামদায়ক বিকেল। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ আমার ঘরের জানালার কাঁচ গলে আমার পড়ার টেবিলে এসে পড়েছে। আমি এরিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এর একটা জটিল অধ্যায়ে ডুবেছিলাম। শব্দগুলো আমার চোখের সামনে ভাসছিল, কিন্তু মাথায় ঢুকছিল না। আমার মনটা বারবার চলে যাচ্ছিল ডাইনিং টেবিলের দিকে। লায়লা মা আজ আমার পছন্দের মাটন কোর্মা রান্না করছেন। তার রান্নার হাত অসাধারণ। সারা বাড়ি সেই কোর্মার মনমাতানো গন্ধে ভরে আছে।

আমার ঘরটা দোতলার কোণায়। বেশ বড় আর খোলামেলা। একপাশে বইয়ের তাক, তাতে থরে থরে সাজানো আমার পাঠ্যবই আর গল্পের বই। অন্যপাশে আমার সিঙ্গল বেড, পরিপাটি করে গোছানো। দেয়ালের রঙ হালকা নীল। আমার মায়ের পছন্দের রঙ। এই ঘরটা আমার দুর্গ, আমার ব্যক্তিগত জগৎ।

দরজায় হালকা টোকা পড়ল। “আমির, ভেতরে আসব?”

লায়লা মায়ের গলা। তার গলার স্বরে এমন একটা স্নেহ মেশানো থাকে, যা শুনলে মন ভালো হয়ে যায়।

“এসো মা,” আমি বই থেকে মুখ তুলে বললাম।

দরজা খুলে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। তার পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের সুতির শাড়ি। মুখে কোনও মেকআপ নেই, শুধু কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। চল্লিশ বছর বয়সেও তাকে কী অপূর্ব সুন্দরী লাগে! তার চেহারায় একটা অদ্ভুত শান্তি, একটা স্নিগ্ধতা আছে। তিনি হাতে করে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে এসেছেন।

“অনেকক্ষণ ধরে পড়ছিস। একটু ব্রেক নে,” তিনি কফির কাপটা আমার টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন।

“ধন্যবাদ মা। এটারই দরকার ছিল।”

তিনি আমার পাশে রাখা চেয়ারটায় বসলেন। আমার খোলা বইটার দিকে তাকালেন। “কী পড়ছিস এত মন দিয়ে?”

“পলিটিক্যাল ফিলোসফি। খুব বোরিং,” আমি হাসলাম।

তিনিও হাসলেন। তার হাসিতে মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। “পড়াশোনা তো করতেই হবে, বাবা। তোর বাবা তোর ওপর অনেক আশা করে আছে। তুই আমাদের পরিবারের গর্ব।”

তার কথাগুলো আমার বুকে একটা উষ্ণ স্রোতের মতো বয়ে গেল। মায়ের মৃত্যুর পর এই মানুষটাই আমাকে আগলে রেখেছে। আমার পড়াশোনা, আমার খাওয়া-দাওয়া, আমার মন খারাপ—সবকিছুর খেয়াল রাখেন তিনি। আমি জানি, তিনি আমার গর্ভধারিণী মা নন, কিন্তু তার ভালোবাসায় কোনও খাদ নেই।

“তোমার জন্যই তো এতদূর আসতে পেরেছি, মা,” আমি sinceramente বললাম। “তুমি যদি না থাকতে…”

“চুপ কর,” তিনি আমার মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন। “আমি তোর মা। মায়ের কর্তব্য করেছি, এর মধ্যে ‘যদি’, ‘কিন্তু’ কিছু নেই।” তিনি আমার পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে দিলেন। “তোর পাঞ্জাবির বোতামটা ভাঙা। দে, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।”

তিনি আমার খুব কাছে সরে এলেন। তার শরীর থেকে একটা হালকা জেসমিন ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। খুব চেনা, খুব নিরাপদ একটা গন্ধ। তিনি নিচু হয়ে আমার বুকের কাছে ঝুঁকে পড়লেন। তার শাড়ির আঁচলটা আমার হাতের ওপর এসে পড়ল। আমি তার ঘাড়ের কাছে অনাবৃত মসৃণ ত্বকটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনে কোনও নোংরা চিন্তা এল না। শুধু একটা গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা অনুভব করলাম। এই নারী আমার মা। আমার সম্মান।

“হয়ে গেছে,” তিনি বোতামটা লাগিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। “কফিটা খেয়ে নে, ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। “আমি নিচে যাচ্ছি। সারাটা আবার রান্নাঘরে ঢুকে কী সব এক্সপেরিমেন্ট করছে কে জানে। পুরো রান্নাঘরটার দফারফা না করে ছাড়বে না।”

তার কথায় আমি হেসে ফেললাম। সারা, আমার সৎ-বোন। বয়সে আমার থেকে দু’বছরের ছোট। কলেজে পড়ে। সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে। তার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। সারাক্ষণ খুনসুটি, ঝগড়া, আবার একে অপরের জন্য গভীর টান।

লায়লা মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আবার আমার দিকে ফিরলেন। “তাড়াতাড়ি নিচে আসিস। আজ তোর বাবাও তাড়াতাড়ি ফিরবে বলেছে। একসাথে ডিনার করব।”

“আচ্ছা মা,” আমি মাথা নাড়লাম।

তিনি চলে যাওয়ার পরেও ঘরের মধ্যে তার শরীরের সেই মিষ্টি জেসমিন গন্ধটা কিছুক্ষণ রয়ে গেল। আমি কফির কাপে চুমুক দিলাম। পারফেক্ট। ঠিক যেমন আমি খাই। কম চিনি, স্ট্রং। এই ছোট ছোট জিনিসগুলোও তিনি কত খেয়াল রাখেন! আমার মনটা এক গভীর কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবলাম, আল্লাহ যা করেছেন, ভালোর জন্যই করেছেন। তিনি আমার কাছ থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছেন, কিন্তু তার বদলে আর একজন মা-কে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার জীবনটা আবার স্থিতিশীল, আবার সুখী।

সন্ধ্যার পর আমি নিচে নামলাম। ড্রয়িং রুম থেকে সারা আর লায়লা মায়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। আমি রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলাম। যা ভেবেছিলাম, তাই। সারা একটা অ্যাপ্রন পরে স্যালাড বানানোর চেষ্টা করছে, আর অর্ধেক জিনিসপত্র নিচে ফেলে একাকার কাণ্ড করেছে।

“এটা কী হচ্ছে এখানে? বিশ্বযুদ্ধ?” আমি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম।

সারা আমার দিকে ঘুরে তাকাল। তার মুখে শসার টুকরো লেগে আছে। “খবরদার, আমির ভাইয়া! আমার ক্রিয়েটিভিটিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবি না। আজ আমি এমন একটা স্যালাড বানাব, যা খেয়ে বাবা অজ্ঞান হয়ে যাবে।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি,” আমি হাসলাম। “স্যালাড খেয়ে অজ্ঞান হবে, নাকি তোর এই কিম্ভূত চেহারা দেখে, সেটাই ভাবছি।”

“যাহ্! তুমি খুব পচা,” সারা মুখ ভেংচে বলল।

লায়লা মা আমাদের খুনসুটি দেখে হাসছিলেন। “তোরা থামবি? আমির, তুই ওকে একটু সাহায্য কর। আমি বরং ফিরনিটা দেখে আসি।”

লায়লা মা ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকলাম।

“কী করছিস তুই? শসা, টমেটোর সাথে আপেল, আঙুর? এটা স্যালাড না ফ্রুট চাট?” আমি বললাম।

“এটা ফিউশন,” সারা জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল। “তোদের মতো ওল্ড স্কুল জেনারেশন এসব বুঝবে না।”

আমি ওর হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিলাম। “দে, আমাকে দে। তুই বরং প্লেটগুলো গোছা।”

আমি সবজিগুলো কাটতে শুরু করলাম। লায়লা মা পাশে দাঁড়িয়ে ফিরনির বাটিতে পেস্তা-বাদাম ছড়াচ্ছিলেন। রান্নাঘরটা আমাদের তিনজনের উপস্থিতিতে ভরে উঠেছিল। চুলার ওপর কোর্মার ডেকচিটা হালকা আঁচে বসানো। তার গন্ধ, ফিরনির মিষ্টি সুবাস আর আমাদের তিনজনের টুকরো টুকরো কথা, হাসি—সবকিছু মিলে একটা নিখুঁত পারিবারিক মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তটা যেন এভাবেই চিরকাল থেকে যায়।

লায়লা মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর রেজাল্ট কবে দেবে, আমির?”

“এই তো, সামনের সপ্তাহেই হয়তো।”

“টেনশন হচ্ছে?”

“একটু তো হচ্ছেই,” আমি স্বীকার করলাম। “এবার নম্বরটা ভালো না এলে স্কলারশিপটা আটকে যাবে।”

“কিচ্ছু চিন্তা করিস না,” তিনি আমার পিঠে হাত রাখলেন। “তোর পরীক্ষা ভালো হয়েছে, ফলও ভালোই হবে। আমরা সবাই তোর সাথে আছি।”

তার কথায়, তার স্পর্শে আমার সব টেনশন যেন উধাও হয়ে গেল। এই বিশ্বাস, এই ভরসাটাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।

রাত ন’টা। আমরা চারজন ডাইনিং টেবিলে বসেছি। টেবিলের মাঝখানে ধোঁয়া ওঠা বাসমতী চালের পোলাও, মাটন কোর্মা, চিকেন রোস্ট, সারার বানানো সেই অদ্ভুত স্যালাড আর ফিরনির বাটি। মোমবাতির নরম আলোয় পুরো পরিবেশটা আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে।

বাবা, ইরফান চৌধুরী, টেবিলের মাথায় বসেছেন। তার পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। তিনি সারাদিনের কাজের পর বাড়ি ফিরে এই শান্ত, সুখী পরিবেশটা খুব উপভোগ করেন।

“বাহ্, লায়লা! আজকের কোর্মাটা তো অসাধারণ হয়েছে,” বাবা এক লোকমা মুখে দিয়ে বললেন। “তোমার হাতে জাদু আছে।”

লায়লা মা লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। “ধুর! কী যে বলো। আমির সাহায্য করেছে বলেই এত তাড়াতাড়ি হলো।”

“তাই নাকি?” বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। “আমার ছেলে দেখি শুধু পড়াশোনাতেই নয়, রান্নাতেও ফার্স্ট ক্লাস।”

আমি হাসলাম। “সবই মায়ের ট্রেনিং।”

“আর আমার স্যালাডটা কেমন হয়েছে, বাবা?” সারা অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

বাবা এক চামচ স্যালাড মুখে দিলেন। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমরা সবাই হাসতে শুরু করলাম। তিনি কোনওরকমে সেটা গিলে বললেন, “খুব… খুব ইন্টারেস্টিং, মা। তবে পরেরবার থেকে শুধু সবজি দিয়েই বানাস, কেমন?”

সারা মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। “তোমরা কেউই আমার আর্টের কদর করতে জানো না।”

আমরা সবাই আবার হেসে উঠলাম। টেবিলটা আমাদের হাসি, গল্পে ভরে উঠেছিল। বাবা তার ব্যবসার নতুন প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলছিলেন। লায়লা মা সামনের সপ্তাহে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। সারা তার কলেজের ফেস্ট নিয়ে উত্তেজিত ছিল। আর আমি? আমি শুধু এই মুহূর্তটাকে শুষে নিচ্ছিলাম। আমার পরিবার। আমার সুখী পরিবার।

আমার মনে হচ্ছিল, জীবনটা কত সুন্দর! মায়ের মৃত্যুর পর যে অন্ধকার আমার জীবনে নেমে এসেছিল, তা এখন পুরোপুরি কেটে গেছে। আমার একজন বাবা আছেন, যিনি আমাকে নিয়ে গর্ব করেন। একজন মা আছেন, যিনি আমাকে নিজের ছেলের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। আর একটা বোন আছে, যে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমার আর কী চাই?

খাওয়ার শেষে বাবা বললেন, “আমির, আমার পুরনো স্টাডি রুম থেকে শেক্সপিয়রের রচনাবলীটা একবার নিয়ে আসবি? অনেকদিন পড়া হয় না।”

বাবার পুরনো স্টাডি রুমটা তেতলার চিলেকোঠায়। বাবা নতুন স্টাডি রুম বানানোর পর ওটা প্রায় গুদাম ঘর হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

“আচ্ছা বাবা, আমি নিয়ে আসছি,” আমি উঠে দাঁড়ালাম।

আমি সিঁড়ি বেয়ে তেতলার দিকে এগোতে লাগলাম। আমার মনটা তখন এক অনাবিল শান্তিতে পরিপূর্ণ। আমি জানতাম না, কয়েক মুহূর্ত পরেই এই শান্তি, এই সুখ, এই বিশ্বাস—সবকিছু কাঁচের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আমি জানতাম না, আমি আসলে স্বর্গের দিকে নয়, হাঁটছিলাম আমার জীবনের ভয়ংকরতম জাহান্নামের দিকে।

তেতলার ঘরটা অন্ধকার, ধুলোয় ভরা। আমি লাইটের সুইচটা অন করলাম। ফ্যাকাসে আলোয় ঘরটা ভেসে গেল। চারপাশে পুরনো আসবাবপত্র, বাতিল হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র আর বইয়ের স্তূপ। বাতাসে পুরনো কাগজের একটা সোঁদা গন্ধ। এই ঘরটার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় মায়ের সাথে এখানে এসে লুকোচুরি খেলতাম।

বাবার পুরনো বইয়ের তাকটা ঘরের এক কোণায়। বিশাল, উঁচু একটা শেলফ। আমি শেক্সপিয়রের রচনাবলীটা খুঁজতে লাগলাম। বইগুলো অনেকদিন নাড়াচাড়া করা হয়নি, পুরু ধুলোর আস্তরণ জমেছে।

বইটা খুঁজতে খুঁজতেই আমার চোখ গেল শেলফের সবচেয়ে ওপরের তাকের দিকে। একটা মোটা বইয়ের পেছনে কী একটা যেন আটকে আছে। কৌতূহলী হয়ে আমি একটা টুল টেনে নিয়ে ওপরে উঠলাম।

ওটা একটা কাঠের বাক্স। পুরনো, নকশা করা একটা ছোট সিন্দুকের মতো। বাক্সটা বেশ ভারী। আমি সাবধানে ওটা নিচে নামিয়ে আনলাম। বাক্সটার ওপর ধুলোর পুরু আস্তরণ। আমি হাত দিয়ে ধুলোটা মুছলাম। কোনও তালা দেওয়া নেই।

আমার ভেতরে একটা অদ্ভুত কৌতূহল জেগে উঠল। এটা বাবার ব্যক্তিগত বাক্স হতে পারে। খোলাটা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু আমার মন মানছিল না। এই পরিত্যক্ত ঘরে, সবার চোখের আড়ালে এই বাক্সটা কেন লুকানো থাকবে? এর ভেতরে কী এমন আছে?

কিছুক্ষণ দ্বিধা করে, আমি শেষ পর্যন্ত বাক্সটার ডালাটা খুললাম।

ভেতরে যা ছিল, তা দেখে আমি একটু হতাশই হলাম। কিছু পুরনো কাগজপত্র, হলদে হয়ে যাওয়া চিঠি, আর একটা চামড়ার বাঁধাই করা ডায়েরি। হয়তো বাবার পুরনো দিনের স্মৃতি।

আমি প্রথমে ডায়েরিটা হাতে নিলাম। পাতা ওল্টাতেই একটা পরিচিত হাতের লেখা আমার চোখে পড়ল।

লায়লা মায়ের হাতের লেখা।

আমি অবাক হলাম। লায়লা মায়ের ডায়েরি বাবার পুরনো বাক্সে কী করছে? তাও এত লুকিয়ে?

আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। আমি ডায়েরিটা রেখে চিঠিগুলোর দিকে হাত বাড়ালাম। অনেকগুলো চিঠি, নীল রঙের খামে ভরা। আমি প্রথম খামটা খুললাম। ভেতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বেরিয়ে এল। আমি কাগজটা খুললাম।

চিঠিটা লায়লা মায়েরই লেখা। কিন্তু প্রাপকের জায়গায় কোনও নাম নেই।

আমি চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। প্রথম কয়েকটা লাইন ছিল সাধারণ কুশল বিনিময়ের মতো। কিন্তু তারপরের লাইনটা পড়েই আমার পৃথিবীটা দুলে উঠল। আমার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।

চিঠিতে লেখা ছিল:

“প্রিয়তম, আমি আর পারছি না। আমিনার অসুস্থতার অভিনয় আমার অসহ্য লাগছে। তুমি বলেছিলে, আর কয়েকটা মাস। তারপর ও চলে গেলেই আমরা এক হতে পারব। কিন্তু ওর এই ধুঁকে ধুঁকে মরাটা আমি আর দেখতে পারছি না। ইরফানকে বোকা বানানো খুব সহজ, কিন্তু আমার নিজের বিবেকের সাথে আমি আর পেরে উঠছি না। তুমি প্ল্যানটা তাড়াতাড়ি কার্যকর করো। ওকে আমাদের রাস্তা থেকে সরাও। চিরদিনের জন্য। তারপর আমি, তুমি আর আমাদের সারা—আমরা একটা নতুন জীবন শুরু করব।”

আমি চিঠিটা আর পড়তে পারলাম না। আমার হাত থেকে কাগজটা খসে পড়ল। আমার কান দুটো ভোঁ ভোঁ করছিল। মাথাটা ঘুরছিল। আমি টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়লাম।

চিঠির নিচের কোণায় তারিখটা দেওয়া। আমার মায়ের মৃত্যুর ঠিক তিন মাস আগের তারিখ।

আমিনা। আমার মা। তার অসুস্থতা… অভিনয় ছিল? তাকে… রাস্তা থেকে সরানো হয়েছে?

আমার মস্তিষ্ক কোনও কিছু আর বিশ্লেষণ করতে পারছিল না। লায়লা মা… আমার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার লায়লা মা… তিনি… তিনি আমার মায়ের হত্যাকারী? আর বাবা? ইরফান চৌধুরী? তিনিও কি এই ষড়যন্ত্রে জড়িত? “ইরফানকে বোকা বানানো খুব সহজ”—এই লাইনটা আমার কানের ভেতরে হাতুড়ির মতো ঘা মারছিল।

আমার সুখী পরিবার। আমার নিরাপদ আশ্রয়। আমার ভালোবাসা। সবকিছু এক মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল। একটা ভয়ংকর, পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।

আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল ডাইনিং টেবিলের সেই দৃশ্যটা। বাবার তৃপ্তির হাসি, লায়লা মায়ের স্নেহমাখা মুখ, সারার উচ্ছ্বাস। সবকিছু একটা নিখুঁত অভিনয়। একটা মুখোশ। আর সেই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে দুটো ঠান্ডা মাথার খুনি।

আমার বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। তীব্র ঘৃণা, অবিশ্বাস আর অসহায়ত্বে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছিল না।

আমি কাঁপতে কাঁপতে বাক্সটার দিকে তাকালাম। ডায়েরিটা। চিঠিগুলো। এই বাক্সটা শুধু একটা বাক্স নয়। এটা একটা প্যান্ডোরার বাক্স। যার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে আমার পরিবারের কদর্য, ভয়ংকরতম সত্যিটা।

আমার আপাত সুখের পৃথিবীটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি এক ভয়ংকর সত্যের সামনে। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি জাহান্নামের পথে।

Series Navigationজাহান্নামের পথ – অঙ্ক ২ ও ৩ >>

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top