জাহান্নামের পথ – অঙ্ক ২ ও ৩

This entry is part 2 of 6 in the series জাহান্নামের পথ

জাহান্নামের পথ

অঙ্ক ২: সত্যের উন্মোচন

তেতলার সেই ধুলোমাখা, পরিত্যক্ত ঘরটা এক মুহূর্তে আমার ব্যক্তিগত জাহান্নামে পরিণত হলো। আমার হাতে ধরা চিঠিটা আর শুধু একটা কাগজ ছিল না; ওটা ছিল আমার জীবনের সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত শ্রদ্ধাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া একটা আগুনের গোলা। আমার কান ভোঁ ভোঁ করছিল, চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। মেঝের ঠান্ডা পাথরও আমার শরীরের ভেতরের জ্বালাকে শান্ত করতে পারছিল না।

আমিনা। আমার মা। তার অসুস্থতা একটা অভিনয় ছিল? তাকে রাস্তা থেকে সরানো হয়েছে? এই শব্দগুলো আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের শেষ দিনগুলোর ছবি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা একটা শীর্ণ, দুর্বল শরীর। কেমোথেরাপির অত্যাচারে উঠে যাওয়া সমস্ত চুল। চামড়ার নিচে ফুটে ওঠা হাড়ের কাঠামো। নিষ্প্রভ চোখ দুটোয় বেঁচে থাকার কী আকুল আকুতি! সেই চোখ দুটো কি অভিনয় করছিল? সেই যন্ত্রণা, সেই কষ্ট, সবটা কি ছিল একটা সাজানো নাটক?

না! হতে পারে না। আমি নিজের চোখে আমার মাকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখেছি। তার প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের কষ্ট আমি অনুভব করেছি। তাহলে? তাহলে চিঠির ওই লাইনটার মানে কী?

আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কাঁপতে কাঁপতে আমি আবার বাক্সটার দিকে হাত বাড়ালাম। আরও চিঠি আছে। আমাকে সবটা জানতে হবে। এই ষড়যন্ত্রের শিকড় কতটা গভীরে, আমাকে তা খুঁজে বের করতেই হবে।

আমি দ্বিতীয় চিঠিটা খুললাম। এটাও লায়লারই লেখা।

“প্রিয়তম, আমি জানি তুমি অধৈর্য্য হয়ে পড়ছ। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার অবস্থাও ভালো নয়। প্রতিদিন সকালে উঠে ওই অসুস্থ মহিলার সেবা করার অভিনয় করা, ইরফানের সামনে একজন সহানুভূতিশীল বন্ধুর মতো ব্যবহার করা—এই সবকিছু আমার আত্মাকে নিংড়ে নিচ্ছে। সেদিন ডাক্তার যখন বললেন যে আমিনার হাতে আর বেশি সময় নেই, আমি দেখেছিলাম ইরফানের চোখে স্বস্তি। সেও মুক্তি চায়। কিন্তু লোকটা বড্ড ভীতু। সমাজের চোখে সে একজন ধার্মিক, সম্মানীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে চায়। সে নিজে কিছু করবে না, কিন্তু সে চায়, কাজটা হয়ে যাক।”

আমার নিঃশ্বাস আটকে এল। বাবা! আমার বাবা! তিনিও মুক্তি চেয়েছিলেন? আমার মায়ের মৃত্যুতে তিনি স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিলেন? যে মানুষটা মায়ের মৃত্যুর পর আমার সামনে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, সে সবটাই ছিল অভিনয়? আমার মনে পড়ল, মায়ের অসুস্থতার সময় বাবা প্রায়ই ব্যবসার কাজে বাইরে থাকতেন। বলতেন, মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে হচ্ছে। সে সবও কি মিথ্যে ছিল? তিনি কি আসলে আমার মাকে এড়িয়ে চলতেন? লায়লার সাথে সময় কাটানোর জন্য অজুহাত খুঁজতেন?

ঘৃণায়, বিতৃষ্ণায় আমার গা গুলিয়ে উঠল। আমি আর চিঠিগুলো পড়তে পারছিলাম না। আমার হাত চলে গেল সেই চামড়ার ডায়েরিটার দিকে। এটা বাবার ডায়েরি। লায়লা মায়ের হাতের লেখাটা আমি চিনি। কিন্তু বাবার লেখা? আমি কোনওদিন দেখিনি।

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়েরিটা খুললাম। প্রথম পাতাটা খালি। দ্বিতীয় পাতায় তারিখ দেওয়া। আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ার ঠিক পরের মাসের তারিখ।

“আজ আমিনার দ্বিতীয় কেমোর দিন ছিল। ওর কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না। সারারাত যন্ত্রণায় ছটফট করে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি জানি, একজন স্বামী হিসেবে আমার ওর পাশে থাকা উচিত। কিন্তু আমি পারছি না। ওর ওই রুগ্ন শরীর, ওষুধের গন্ধ, সারাক্ষণের কান্না—এই সবকিছু আমার ভেতরটাকে অবসাদে भरিয়ে দিচ্ছে। আমি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাই।”

পরের কয়েকটা পাতা জুড়ে শুধু বাবার অসহায়ত্ব আর ক্লান্তির কথা। তিনি লিখেছেন, কীভাবে তিনি তার অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কীভাবে তিনি নিজের জীবনটাকে একটা বোঝা বলে মনে করছেন।

তারপর, কয়েক পাতা পর, একটা নতুন নামের প্রবেশ ঘটল। লায়লা।

“আজ লায়লার সাথে দেখা হলো। ও ওর স্বামীর মৃত্যুর পর বড্ড একা হয়ে পড়েছে। ওর সাথে কথা বলে অনেকদিন পর শান্তি পেলাম। মনে হলো, পৃথিবীতে এখনও সৌন্দর্য আছে, জীবন আছে। ওর চোখ দুটোয় কী গভীর মায়া! ওর হাসিতে যেন সব কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়।”

ডায়েরির পাতা যত ওল্টাচ্ছিল, আমার কাছে সবকিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। আমার বাবা, ইরফান চৌধুরী, যখন আমার মা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তখন তিনি লায়লার মধ্যে জীবনের আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন। তাদের দেখা করা বাড়তে লাগল। প্রথমে সহানুভূতি, তারপর বন্ধুত্ব, আর তারপর… প্রেম।

একটা পাতায় এসে আমার চোখ আটকে গেল।

“লায়লা ঠিকই বলে। আমি একটা কাপুরুষ। আমি আমিনাকে ছাড়তেও পারছি না, আবার ওর এই কষ্ট সহ্যও করতে পারছি না। লায়লা আমাকে একটা পথের কথা বলেছে। একটা উপায়, যাতে আমিনা ওর এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়, আর আমরাও আমাদের জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারি। প্ল্যানটা ভয়ংকর। কিন্তু এছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। আমি যদি লায়লাকে হারাতে না চাই, তাহলে আমাকে এটা করতেই হবে। আল্লাহ্, তুমি আমাকে শক্তি দাও।”

আমার শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেল। প্ল্যান! সেই একই শব্দ, যা আমি লায়লার চিঠিতেও পড়েছি। তাহলে, আমার বাবা শুধু নিষ্ক্রিয় দর্শক ছিলেন না, তিনি এই ষড়যন্ত্রের একজন সক্রিয় অংশীদার ছিলেন। তারা দুজন মিলে আমার মাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছে!

কীভাবে? কীভাবে তারা আমার মাকে মেরেছে? “অসুস্থতার অভিনয়”—লায়লার এই কথাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমার মায়ের ক্যান্সার তো সত্যি ছিল। তাহলে? তারা কি ভুল ওষুধ দিয়েছিল? নাকি ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করেছিল? যাতে সবকিছুকে একটা স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয়?

আমার চোখের সামনে মায়ের সেই দুর্বল, অসহায় মুখটা ভেসে উঠল। শেষ দিনগুলোয় মা প্রায়ই বলতেন, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমির। শরীরটা আর চলছে না।” আমি ভাবতাম, এটা রোগের যন্ত্রণা। আমি কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি, তার এই কষ্টের পেছনে তার নিজের স্বামী আর তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতার হাত থাকতে পারে।

আমার ভেতরের সমস্ত শ্রদ্ধা, সমস্ত ভালোবাসা এক মুহূর্তে তীব্র, ভয়ংকর ঘৃণায় রূপান্তরিত হলো। যে বাবাকে আমি আমার জীবনের আদর্শ বলে মনে করতাম, তিনি একজন ঠান্ডা মাথার খুনি। যে মহিলাকে আমি আমার মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম, তিনি এক ডাইনি, এক বিশ্বাসঘাতক। তারা দুজন মিলে আমার মাকে ঠকিয়েছে। তারা আমাকে ঠকিয়েছে।

আমার আর কান্না পাচ্ছিল না। আমার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। তার জায়গায় জন্ম নিচ্ছিল এক শীতল, হিসেবি প্রতিশোধের আগুন। আমি আর সেই একুশ বছরের সংবেদনশীল, বুদ্ধিমান ছেলেটা নেই। আমি এখন এক শিকারি। আর আমার শিকার—আমার পুরো পরিবার।

আমি জানি, আমি যদি এখন পুলিশে যাই, চিৎকার করে সবাইকে সত্যিটা জানাই, তাহলে কী হবে? হয়তো তারা ধরা পড়বে, শাস্তি হবে। কিন্তু তাতে আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে? আমি যে কষ্টটা পাচ্ছি, তার ভাগ কি তারা পাবে? না। আইনি শাস্তি এদের জন্য যথেষ্ট নয়। এদেরকে সেই যন্ত্রণা দিতে হবে, যা এরা আমার মাকে দিয়েছে। তিলে তিলে, একটু একটু করে।

আমার বাবাকে ধ্বংস করার সবচেয়ে সহজ উপায় কী? তার সম্মান, তার প্রতিপত্তি, তার ব্যবসা? না। ইরফান চৌধুরীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তার বর্তমান সুখের উৎস। তার ভালোবাসা। লায়লা।

আমি যদি লায়লাকে তার জীবন থেকে কেড়ে নিতে পারি? আমি যদি লায়লাকে তার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে পারি? আমি যদি তাদের এই ভালোবাসার প্রাসাদটাকে ভেতর থেকে ঘুণ ধরিয়ে দিতে পারি? সেটাই হবে আমার বাবার জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি। তাকে তার নিজের পাতা ফাঁদেই ফেলতে হবে।

আমার মাথায় একটা পরিষ্কার পরিকল্পনা তৈরি হয়ে গেল। একটা নোংরা, কদর্য, কিন্তু কার্যকরী পরিকল্পনা। এই খেলায় আমাকেও তাদের মতোই ঠান্ডা মাথার অভিনেতা হতে হবে। আমাকে আমার ঘৃণা, আমার কষ্ট, সবকিছুকে একটা হাসির মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে হবে।

আমি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পা দুটো আর কাঁপছিল না। আমার শরীর স্থির, মন শান্ত। আমি বাক্সটা থেকে সমস্ত চিঠি আর ডায়েরিটা বের করলাম। তারপর একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ধরলাম।

প্রথমে একটা চিঠি। তারপর আর একটা। তারপর ডায়েরির পাতাগুলো। হলদে হয়ে যাওয়া কাগজগুলো আগুনের স্পর্শে কুঁকড়ে যেতে লাগল। আমার চোখের সামনে পুড়ে যাচ্ছিল আমার অতীত, আমার বিশ্বাস। আর সেই আগুনের লেলিহান শিখায় জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন আমির।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমি সেই গরম ছাইগুলো আমার মুঠোর মধ্যে নিলাম। তারপর টলতে টলতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।

নিচে, লিভিং রুমে, আলো জ্বলছিল। সোফায় আমার বাবা আর লায়লা মা বসে হাসিমুখে গল্প করছিল। তাদের সুখী সংসারের নিখুঁত ছবি।

আমি আমার মুঠিটা খুললাম। রাতের বাতাসে ছাইগুলো উড়ে গেল। কিছু ছাই হয়তো নিচে গিয়ে তাদের গায়েও পড়ল। তারা টেরও পেল না।

আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “আম্মাকে দেওয়া কষ্টের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব আমি নেব। তোমার সুখের এই প্রাসাদ আমি নিজের হাতে জাহান্নাম বানাবো, আব্বু।”

অঙ্ক ৩: প্রলোভনের জাল

সেই রাতের পর থেকে আমি আর আগের আমির রইলাম না। আমার ভেতরের ছেলেমানুষী, আমার সারল্য—সবকিছু সেই ছাইয়ের সাথে বাতাসে উড়ে গিয়েছিল। আমি এখন একজন অভিনেতা। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আমি অভিনয় করতে চলেছি। আমার মুখে হাসি, চোখে स्नेह, কিন্তু আমার হৃদয়ের গভীরে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন।

আমার আচরণের পরিবর্তনটা ছিল খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু স্পষ্ট। এতটাই সূক্ষ্ম যে প্রথম কয়েকদিন কেউ, এমনকি লায়লাও, কিছু ধরতে পারেনি। আমি আগের মতোই পড়াশোনা করতাম, বাবার সাথে ব্যবসার কথা বলতাম, সারার সাথে খুনসুটি করতাম। কিন্তু সবটাই ছিল একটা calculado পদক্ষেপ।

প্রথম পরিবর্তনটা আনলাম আমার দৃষ্টিতে। আমি লায়লার সাথে কথা বলার সময় এখন তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকতাম। দীর্ঘক্ষণ। আমার দৃষ্টিতে থাকত না আগের মতো সেই মাতৃশ্রদ্ধার সরলতা। থাকত এক গভীর, অন্তর্ভেদী চাহনি। যেন আমি তার মনের ভেতরটা পড়ে ফেলার চেষ্টা করছি।

প্রথমবার যখন আমি এটা করলাম, লায়লা একটু অস্বস্তিতে পড়েছিল। আমরা ডাইনিং টেবিলে বসেছিলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, আমার কোনও সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা। আমি তার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললাম, “আমার সবচেয়ে বড় সাহায্য তো তুমিই, মা। তুমি পাশে থাকলে আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই।”

আমার কথাগুলো ছিল নিরীহ। কিন্তু আমার চাহনিটা ছিল অন্যরকম। লায়লা কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। তার গালে একটা হালকা লাল আভা ফুটে উঠেছিল। সে হয়তো ভেবেছিল, এটা আমার বয়স বাড়ার ফল। আমার কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়ার স্বাভাবিক পরিবর্তন। সে বুঝতে পারেনি, এটা ছিল আমার খেলার প্রথম চাল।

আমি উদ্দেশ্যমূলকভাবে লায়লার কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি করতে লাগলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, তার ব্যক্তিগত গণ্ডির ভেতরে প্রবেশ করা। তাকে অস্বস্তিতে ফেলা। তাকে আমার উপস্থিতি সম্পর্কে সারাক্ষণ সচেতন রাখা।

একদিন সকালে আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। লায়লা ফ্রিজ থেকে কিছু বের করার জন্য ঝুঁকেছিল। তার পরনে ছিল একটা পাতলা, শিফনের শাড়ি। শাড়ির আঁচলটা সরে গিয়ে তার মসৃণ, ফর্সা পিঠটা অনাবৃত হয়ে পড়েছিল। আমি ইচ্ছে করেই তার খুব কাছ দিয়ে গেলাম। এতটাই কাছ দিয়ে যে আমার শরীর তার শরীরে আলতো করে স্পর্শ করল।

“সরি মা,” আমি সাথে সাথেই বললাম। “খেয়াল করিনি।”

লায়লা সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার মুখে একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। সে চমকে উঠেছে, কিন্তু সে রাগ দেখাতে পারছে না। কারণ আমার আচরণে কোনও অভদ্রতা ছিল না। ছিল শুধু একটা ‘ভুল’।

“না, ঠিক আছে,” সে একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল।

কিন্তু আমি তার চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, সে ঠিক নেই। আমার ওই সামান্য স্পর্শে তার সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। সে শাড়ির আঁচলটা টেনে পিঠটা ঢেকে নিল। আমি মনে মনে হাসলাম। আমার দ্বিতীয় চালটাও সফল।

আমার এই খেলাটা ক্রমশ আরও大胆 হতে লাগল। আমি জানতাম, লায়লার মনে একটা ধর্মভীরু, সংস্কারি দিক আছে। আমি ঠিক সেই জায়গাটাতেই আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলাম।

একদিন বিকেলে, লায়লা নামাজের জন্য ওযু করছিল। আমি ইচ্ছে করেই বাথরুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে কলঘরে বসে তার মুখ ধুচ্ছিল। জলের ফোঁটা তার মুখ, গলা, ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। ভেজা মুখে তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। একটা অপার্থিব পবিত্রতা যেন তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।

সে ওযু করে উঠে দাঁড়াতেই আমাকে দেখতে পেল। সে একটু চমকে উঠল।

আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার চোখে মুগ্ধতা। আমি খুব নরম, প্রায় ফিসফিসে গলায় বললাম, “আপনাকে খুব পবিত্র দেখাচ্ছে, লায়লা আন্টি।”

আমার কণ্ঠস্বরের ঘনিষ্ঠতা, আমার মুগ্ধ দৃষ্টি—সবকিছু মিলে লায়লাকে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে ফেলে দিল। তার মুখটা লাল হয়ে গেল। সে কী বলবে বুঝতে না পেরে দ্রুত আমার পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমি জানতাম, সে বিচলিত হচ্ছে। আমার এই পরিবর্তনগুলো সে আর এড়িয়ে যেতে পারছে না। সে হয়তো বাবার সাথে আলোচনা করার কথা ভাবছে। কিন্তু সে কী বলবে? বলবে, তোমার ছেলে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়? আমার গায়ে ‘ভুল করে’ হাত দেয়? আমাকে এমন কথা বলে, যা শুনলে অস্বস্তি হয়? এই অভিযোগগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে এগুলোকে প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। উল্টে সে-ই হয়তো খারাপ হয়ে যাবে। সবাই ভাববে, সে একটা সৎ-ছেলের নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে।

আমি ঠিক এই অসহায়ত্বের সুযোগটাই নিচ্ছিলাম।

আমার পরবর্তী পদক্ষেপটা ছিল আরও ভয়ংকর। আমি ঠিক করলাম, এবার শুধু মানসিক নয়, সামান্য শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও তৈরি করতে হবে। এমন একটা স্পর্শ, যা আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক, কিন্তু তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

একদিন সন্ধ্যায় আমরা সবাই লিভিং রুমে বসেছিলাম। বাবা টিভি দেখছিলেন, সারা ফোনে কথা বলছিল, আর লায়লা সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। তার পায়ে ছিল একজোড়া সুন্দর স্যান্ডেল।

আমি তার পায়ের কাছে, মেঝেতে বসলাম।

“কী হলো, আমির? নিচে বসলি কেন?” লায়লা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

আমি তার পায়ের দিকে তাকালাম। “তোমার স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপটা মনে হয় ছিঁড়ে গেছে, আন্টি।”

এটা একটা ডাহা মিথ্যে কথা। কিন্তু সে তো আর নিচু হয়ে দেখবে না।

“তাই নাকি?” সে চিন্তিত গলায় বলল। “এটা আমার খুব পছন্দের স্যান্ডেল।”

“দাঁড়াও, আমি দেখছি,” আমি বললাম।

তারপর, সবার চোখের সামনে, আমি তার পা থেকে স্যান্ডেলটা খোলার ভান করে তার মসৃণ, ফর্সা পায়ে হাত দিলাম। আমার আঙুলগুলো তার পায়ের পাতাকে স্পর্শ করল।

মুহূর্তের জন্য যেন সময় থেমে গেল।

আমার স্পর্শে লায়লার সারা শরীর কেঁপে উঠল। তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। সে দ্রুত পা-টা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আমি তার পা-টা আলতো করে ধরে রেখেছিলাম।

বাবার চোখ ছিল টিভির দিকে। সারার ব্যস্ত ছিল ফোনে। কেউ কিছু লক্ষ্য করল না। শুধু আমি আর লায়লা জানতাম, এই মুহূর্তে আমাদের মধ্যে কী ঘটে গেল। এটা শুধু একটা সামান্য স্পর্শ ছিল না। এটা ছিল একটা সীমানা লঙ্ঘন। একটা সামাজিক, ধর্মীয় এবং পারিবারিক সম্পর্কের পবিত্রতাকে চ্যালেঞ্জ করা।

আমি কয়েক সেকেন্ড তার পা-টা ধরে রেখে, তারপর স্যান্ডেলটা হাতে নিয়ে বললাম, “না, ছেঁড়েনি। একটু আটকে গিয়েছিল। ঠিক করে দিয়েছি।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু আমার আঙুলের ডগায় তখনও তার পায়ের ত্বকের সেই নরম, উষ্ণ অনুভূতিটা লেগেছিল।

লায়লার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। সে আমার দিকে তাকাতে পারছিল না। সে দ্রুত উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

আমি জানতাম, আমি তার মনের গভীরে ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছি। সে এখন আর আমাকে তার নিরীহ, শ্রদ্ধাশীল সৎ-ছেলে বলে মনে করে না। সে আমাকে ভয় পেতে শুরু করেছে। এক অজানা, অচেনা ভয়। আর এই ভয়টাই আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

খেলাটা अब জমে উঠেছিল। আমি আমার জালের সুতোগুলো একটা একটা করে গোটাচ্ছিলাম। শিকার বুঝতে পারছিল যে সে আটকা পড়ছে, কিন্তু তার চিৎকার করার বা পালানোর কোনও উপায় ছিল না।

কয়েকদিন পর আমি আমার চূড়ান্ত চালটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। সুযোগটা নিজে থেকেই এসে গেল। বাবা একটা বিজনেস কনফারেন্সের জন্য দুদিনের জন্য শহরের বাইরে গেলেন। আর সেদিনই সারার কলেজের একটা এডুকেশনাল ট্যুর ছিল। সেও রাতের জন্য বাড়ি ফিরবে না।

বাড়িতে শুধু আমি আর লায়লা।

রাত দশটা বাজে। আমি জানি, লায়লা সাধারণত এই সময় নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ে। আমি অপেক্ষা করছিলাম। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ।

আমি ধীরে ধীরে আমার ঘর থেকে বেরোলাম। আমার হৃদপিণ্ডটা জোরে ধকধক করছিল, কিন্তু আমার পদক্ষেপ ছিল স্থির। আমি লায়লার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজাটা ভেজানো ছিল। ভেতর থেকে হালকা আলো আসছিল।

আমি কোনও শব্দ না করে ভেতরে ঢুকলাম।

লায়লা জায়নামাজের ওপর বসেছিল। তার পরনে একটা সাদা সালোয়ার-কামিজ, মাথায় ওড়না। সে চোখ বন্ধ করে তসবিহ পাঠ করছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে যেন এই পৃথিবীর সমস্ত অশান্তি থেকে দূরে, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইছে। হয়তো সে আমার তৈরি করা অশান্তি থেকেই মুক্তি খুঁজছিল।

আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সে চোখ খুলল। আমাকে তার ঘরের ভেতরে, এত রাতে দেখে সে ভয়ে, বিস্ময়ে জমে গেল।

“আমির! তুই… তুই এখানে?” তার গলাটা কাঁপছিল।

আমি কিছু বললাম না। আমি শুধু তার দিকে এক পা এগোলাম। তারপর দরজাটা আমার পেছন থেকে আলতো করে বন্ধ করে দিলাম। শুধু বন্ধই করলাম না, ছিটকিনিটাও তুলে দিলাম।

‘খট’ করে একটা ছোট্ট শব্দ হলো। কিন্তু সেই শব্দটা লায়লার কানে যেন বজ্রপাতের মতো শোনাল।

সে ভয়ে উঠে দাঁড়াল। “দরজা… দরজা বন্ধ করলি কেন, আমির?”

আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। একটা ঠান্ডা, অর্থপূর্ণ হাসি।

আমি তার দিকে আরও এক পা এগিয়ে গেলাম। আমাদের মধ্যে দূরত্ব এখন মাত্র কয়েক ফুটের।

“আমার কিছু কথা বলার ছিল…” আমি বললাম। আমার গলাটা ছিল শান্ত, কিন্তু তার থেকেও বেশি ভয়ংকর।

“…লায়লা।”

এই প্রথম। এই প্রথম আমি তাকে ‘আন্টি’ বা ‘মা’ ছাড়া শুধু তার নামে ডাকলাম।

আমার মুখে নিজের নামটা ওইভাবে শুনে লায়লার ফর্সা মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেল। তার সুন্দর চোখ দুটো বিস্ফারিত। সে বুঝতে পারছিল, আজ রাতে তার নিস্তার নেই। সে আমার পাতা জালে পুরোপুরি আটকা পড়েছে।

জাহান্নামের দরজাটা খুলে গেছে।

Series Navigation<< জাহান্নামের পথ – অঙ্ক ১জাহান্নামের পথ – অঙ্ক ৪ >>

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top