আরিফের প্রশ্নটা একটা ধারালো কাঁচের টুকরোর মতো ঘরের নিস্তব্ধতাকে চিরে ফেলল। “…নাকি ভালোই লাগছিল?”
নুসরাত স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার শরীর থেকে যেন সব রক্ত এক순হূর্তে নেমে গেল। সে ভেবেছিল আরিফ রাগ দেখাবে, চিৎকার করবে, হয়তো অপমান করবে। কিন্তু এমন শীতল, calculado একটা প্রশ্ন সে আশা করেনি। এটা শুধু প্রশ্ন ছিল না, এটা ছিল তার চরিত্র, তার সততার ওপর একটা সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর আঘাত।
কয়েক মুহূর্ত পর তার স্তম্ভিত ভাবটা তীব্র অপমানে রূপান্তরিত হলো। তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল, গাল বেয়ে নামল গরম জলের ধারা।
“তোমার সাহস কী করে হয় আরিফ? গলায় চিৎকার করে উঠল নুসরাত। “তুমি আমার সম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছ? একজন অচেনা লোক আমার সাথে অভদ্রতা করল, আর তুমি আমাকেই দোষ দিচ্ছ? তোমার সামনে তোমার স্ত্রীর অপমান হলো, আর তুমি কিছু না বলে এখন আমাকে জেরা করছ?”
তার প্রতিটি শব্দে ছিল ঘৃণা আর কষ্ট। সে ভেবেছিল, স্বামী হিসেবে আরিফ তাকে রক্ষা করবে, কিন্তু সে দেখল আরিফ তাকে বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
নুসরাতের বিস্ফোরণে আরিফ একটুও বিচলিত হলো না। সে শান্তভাবে হুইস্কির গ্লাসে আরেকটা লম্বা চুমুক দিল। তার চোখ দুটো ছিল আশ্চর্যরকম শান্ত, যেন সে এই প্রতিক্রিয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
সে ধীর পায়ে নুসরাতের দিকে এগিয়ে এল। তার গলায় কোনো রাগ ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত শীতল সহানুভূতি। “ছিঃ নুসরাত, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না। আমি তোমার সম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি, আমি শুধু ইমরানের উদ্দেশ্যটা বোঝার চেষ্টা করছি।”
নুসরাত ফোঁপাচ্ছিল। আরিফ তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “দেখো, এই চুক্তিটা আমাদের জন্য কতটা জরুরি, তা তুমি জানো। আমাদের সব কিছু এর ওপর নির্ভর করছে। ইমরান ছেলেটা… সে তোমার ওপর দুর্বল। এটা স্পষ্ট। আমরা যদি এই দুর্বলতাকে কাজে না লাগাই, তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।”
কথাগুলো বলতে বলতে আরিফের গলাটা ভারী হয়ে এল। সে নুসরাতের চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি তোমার স্বামী, নুসরাত। তোমার সম্মান আমার কাছে সবচেয়ে বড়। কিন্তু এখন আমাদের মাথা ঠান্ডা করে, একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে। এটা কোনো নোংরামি নয়, এটা একটা স্ট্র্যাটেজি। আমাদের ভবিষ্যৎ বাঁচানোর জন্য একটা খেলা।”
আরিফের কথাগুলো ছিল বিষাক্ত মধুর মতো। সে অত্যন্ত কৌশলে ‘অপমান’ শব্দটাকে ‘দুর্বলতা’ আর ‘নোংরামি’ শব্দটাকে ‘স্ট্র্যাটেজি’ দিয়ে বদলে দিল। সে নুসরাতের মনে এই ধারণাটা ঢুকিয়ে দিতে চাইল যে, যা কিছু হবে, তা তাদের ভালোর জন্যই হবে। এটা কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, এটা purely business। সে নুসরাতের কাঁধে আলতো করে চাপ দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, সে একা নয়, তারা ‘দুজনে মিলে’ এই খেলাটা খেলছে।
পরদিন সকালটা এল এক অস্বস্তিকর নীরবতা নিয়ে। বিশাল স্যুইটের ভেতরে দামি আসবাব, নরম কার্পেট, সবকিছুই ছিল, কিন্তু কোনো প্রাণের স্পন্দন ছিল না। রুম সার্ভিসে ব্রেকফাস্ট এল। রুপোর পাত্রে সাজানো খাবার, তাজা ফলের রস—সবই ছিল নিখুঁত, কিন্তু নুসরাত বা আরিফ কেউই ঠিকমতো খেতে পারছিল না। কাঁটা-চামচের শব্দগুলোও যেন অস্বাভাবিক রকমের জোরে বাজছিল।
নুসরাত একবারও আরিফের দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না। গত রাতের কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ‘স্ট্র্যাটেজি’, ‘ভবিষ্যৎ বাঁচানোর খেলা’—এই শব্দগুলো তার কানে বারবার বাজছিল। সে কি সত্যিই আরিফের কথা বিশ্বাস করছে? নাকি নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইছে?
ব্রেকফাস্টের পর আরিফ ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল, আবার তার ব্যবসার জগতে ডুবে গেল। নুসরাত ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নায় যে প্রতিবিম্বটা সে দেখল, তা যেন তার অচেনা। এই কি সেই নুসরাত, যে একদিন নিজের সম্মান আর আত্মমর্যাদাকে সবচেয়ে বড় করে দেখত?
সে নিজের শরীরটার দিকে তাকাল। তার ভরাট মাই, পাতলা কোমর, মসৃণ ত্বক। ইমরান গতকাল এই শরীরটার দিকেই ক্ষুধার্ত বাঘের মতো তাকাচ্ছিল। আর তার স্বামী… সে-ও এখন এই শরীরটাকে একটা পণ্য হিসেবে দেখছে। একটা অস্ত্র, যা দিয়ে সে তার ব্যবসার যুদ্ধ জিততে চায়। একটা তীব্র ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায় তার গা গুলিয়ে উঠল। কিন্তু সেই ঘৃণার নিচে, খুব গভীরে, একটা নিষিদ্ধ শিহরণও কি ছিল না? এতদিন পর কোনো পুরুষের এমন তীব্র, কাঁচা মনোযোগ তার নারীসত্তাকে কি নাড়া দেয়নি? সে আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা খুঁজতে চাইল, কিন্তু পারল না।
ঠিক সেই মুহূর্তে তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। বিছানার ওপর পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে সে দেখল, একটা অচেনা আন্তর্জাতিক নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এসেছে। তার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল।
মেসেজটা খুলতেই সে দেখল, ইমরানের ছবি দেওয়া প্রোফাইল। মেসেজে লেখা:
“গতকাল রাতের জন্য ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গ খুব ভালো লেগেছে। আজ সন্ধ্যায় আমার পেন্টহাউসে একটা ছোট্ট আয়োজন করেছি, শুধু আমরা তিনজন। চুক্তি নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত আলোচনা করার ছিল। আশা করি আসবেন।”
নুসরাতের হাত কাঁপতে শুরু করল। মেসেজটা সরাসরি তাকে পাঠানো হয়েছে। আরিফকে নয়। ইমরান খুব পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে কার সাথে কথা বলতে চায়, কার সঙ্গ তার প্রয়োজন। এটা শুধু একটা আমন্ত্রণ ছিল না, এটা ছিল ক্ষমতার আস্ফালন।
নুসরাত কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে আরিফের সামনে ধরল। তার মনের কোণে হয়তো শেষবারের মতো আশা ছিল, আরিফ এটা দেখে রেগে যাবে, বলবে, “ওর এত সাহস কী করে হয় তোমাকে সরাসরি মেসেজ করার? আমরা কোথাও যাচ্ছি না!”
কিন্তু আরিফের মুখে বিস্ময়ের কোনো চিহ্নই ছিল না। বরং তার চোখে ফুটে উঠল এক ধরনের চাপা উত্তেজনা, এক ধরনের প্রত্যাশার ছাপ। সে শান্তভাবে মেসেজটা পড়ল, তারপর নুসরাতের দিকে তাকিয়ে একটা হালকা হাসি দিয়ে বলল, “এটা তো ভালো খবর। তার মানে সে সত্যিই আগ্রহী। আমাদের যাওয়া উচিত।”
আরিফের এই শীতল, হিসেবি প্রতিক্রিয়া নুসরাতের ভেতরের শেষ প্রতিরোধটুকুও ভেঙে চুরমার করে দিল। সে বুঝতে পারল, সে একা। এই খেলায় তার স্বামী তার রক্ষাকর্তা নয়, বরং তাকে দাবার বোর্ডের ঘুঁটি হিসেবে চালনা করার জন্য প্রস্তুত। আরিফের এই সম্মতিটা ছিল একটা সবুজ সংকেত—একটা অলিখিত অনুমতি, যা নুসরাতের অপরাধবোধের ওপর একটা পাতলা চাদর বিছিয়ে দিল। এখন সে যা করবে, তা আর ‘পাপ’ নয়, তা তাদের দুজনের ‘প্রয়োজন’।
